সাভার প্রতিনিধি: সাভার বাসস্ট্যান্ডের রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় বিশ্ববাসীকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ভয়াবহ এ ঘটনার আজ বৃহস্পতিবার এক যুগ পূর্তি হচ্ছে। ২০১৩ সালের এইদিন ঘটে যাওয়া ঘটনাটি সারা বিশ্বে সবচাইতে বড় শ্রমিক দুর্ঘটনা। এ দুর্ঘটনায় বেঁচে থাকা আহত শ্রমিকরা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে এবং আর্থিকভাবে ভাল নেই।
ভবনটির প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় একটি ব্যাংক, ইলেকট্রনিক, কম্পিউটার, প্রসাধন সামগ্রীও পোশাকের দোকানের পাশাপাশি তৃতীয় তলা থেকে ৮ম তলা পর্যন্ত নিউ ওয়েব বটম্স, নিউ ওয়েব স্টাইল, প্যান্টস অ্যাপারেল্স,প্যান্টম টেক ও ইথারটেক লিমিটেডসহ ৫টি গামের্ন্টস ছিল।
দুর্ঘটনায় আহত শ্রমিকরা কেউ কেউ ছোট পরিসরে বিভিন্ন ব্যবসা আবার অনেকে শরীরের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হারিয়ে এখন সারা জীবনের জন্য পঙ্গু হয়ে বেকার জীবন যাপন করছেন। তাদের অভিযোগ সারা বছর কেউ তাদের কোনো খোঁজখবর নেয়নি। দিবস আসলেই খোঁজ নেন। দিবস চলে গেলে খোঁজ খবরও শেষ।
রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পূর্ণবাসন, সুচিকিৎসা, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের অনুদানের টাকা আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান ও তার বড় স্ত্রীর বিরুদ্ধে রানা প্লাজার শ্রমিকদের টাকা আত্মসাত করার অভিযোগ করেছে শ্রমিক নেতারা। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়াসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কর্মসূচি পালন ও করা হয়।
রানা প্লাজার ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের দাবি আদায় আন্দোলনের সভাপতি নূরুল ইসলাম বলেন, ‘রানা প্লাজার ধ্বসের ২ মাস পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আহত শ্রমিকদের জনপ্রতি ১০ হাজার টাকা করে দিলেও ডা: এনামুর রহমানের বড় স্ত্রী রওশন আরা আমাদের আহত শ্রমিকদের নাম ঠিকানা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে পাঠাবে বলে আমাদের থেকে তা নিয়ে কোনো টাকা আর আমাদের দেয়া হয়নি।’
নূরুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন- ‘ওই ফান্ডে সাড়ে ৩ কোটি টাকা রওশন আরা আত্মসাত করেছেন।’
এ ছাড়াও তিনি আরো বলেন, ‘শেখ হাসিনা সরকার ক্ষমতা থাকাকালীন সময় তৎকালীন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী ওই সময় সংসদে বলেছিলেন- বিদেশ থেকে ব্যাংকে ১২৭ কোটি টাকা জমা পড়েছে। ব্যাংকে টাকা রাখার জায়গা নেই। অথচ ওই ফান্ড থেকে আমাদের শ্রমিকদের ২২ কোটি টাকা দিলেও ১০৫ কোটি টাকা কোথায় গেল।’
তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান এবং ওই সময়ের সরকারের সাথে থাকা কর্তা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে এ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ করেন।
তিনি রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের অনুদানের টাকা আত্মসাৎকারীদের থেকে উদ্ধার করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক পরিবারকে দেয়া, ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকের সন্তানদের উচ্চশিক্ষার জন্য সরকারি অনুদানের ব্যবস্থা করা, যেসব ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট করা হয় নাই তাদের অ্যাকাউন্ট করা, রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের অনুদানের টাকা আত্মসাৎকারী রাজনৈতিক নেতা- শ্রমিক নেতা ও এনজিওদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার দাবি করেন।
১৯৮৬ সালে নরসিংদী জেলার রায়পুরায় জন্ম নেয়া ডা. এনামুর রহমান সাভার উপজেলা স্বাস্থ্য কপ্লেক্সের আরএমও হিসেবে যোগ দেন। যোগ দিয়েই চিকিৎসা ব্যবসায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। সে সময় সাভারে একটি ওষুধের দোকান দিয়ে সেখানেই রোগী দেখার চেম্বার খোলেন।
১৯৯০ সালে হাসপাতালে দায়িত্ব অবহেলার কারণে তাকে মানিকগঞ্জ জেলার সাটুরিয়ায় বদলি করা হয়। বদলির পর ব্যবসায় ভাটা পড়তে থাকে। সিদ্ধান্ত নেন চাকরি ছাড়ার।
১৯৯১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে দলটির নেতাদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলেন। সাভারের মুক্তির মোড়ে প্রতিষ্ঠা করেন এনাম ক্লিনিক। এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি। সজ্জন, বিনয়ী আর সেবা প্রদানের লেবাস ধারণ করে ডা. এনাম সাভারের মাঠে-প্রান্তরে ঘুরে ঘুরে অল্পদিনের মধ্যে জনপ্রিয় করে তোলেন এনাম ক্লিনিক। বিএনপি সরকারের আমলে সাবেক স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী আমান উল্লাহ আমানের আনুকূল্য পেয়ে কপাল খোলে তার।
২০০১ সালের পর বিএনপি সরকার অনুমোদন দেয় এনাম মেডিক্যাল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের। ব্যবসার পরিধি বাড়তে থাকে রাতারাতি। সাভারের রানা প্লাজা ধসের পর এনাম মেডিক্যাল কলেজের সহায়তা আহতদের জন্য আবশ্যক হয়ে পড়ে। এতেই ভাগ্যদেবী আশীর্বাদ হয়ে দেখা দেয় ডা: এনামের দুয়ারে। অপরদিকে বিশ্বে সবচাইতে বড় শ্রমিক দুর্ঘটনা সম্পর্কে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে বিভিন্নভাবে যখন দেশ-বিদেশ থেকে চাপ প্রয়োগ করা হয় তখন তিনি সংসদে বলেছিলেন রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানা যুবলীগের কেউ না। পরে যখন বিভিন্নভাবে প্রমাণিত হয় সোহেল রানা যুবলীগের, তখনই কপাল পোড়ে সাভারের আওয়ামী লীগ মনোনীত সংসদ সদস্য তৌহিদ জং মুরাদের। গা ঢাকা দেন মুরাদ জং।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের টিকিট পেয়ে যান ডা: এনামুর রহমান। ওই নির্বাচনে জিততে ভোটারদের কাছে যেতে হয়নি এনামকে। মুরাদ জং এলাকায় না থাকায় আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষ থেকে কোনো চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হয়নি তাকে। কেন্দ্র থেকে টিকিট পেয়েই ধরাকে সরা জ্ঞান করেন তিনি। আর পিছনে তাকাতে হয়নি এনামুর রহমানকে। পরে একাধিক বিবাহসহ নামে-বেনামে সম্পদ আর টাকার পাহাড় গড়ে তোলেন তিনি।
আওয়ামী লীগের ঢাকা জেলা সহ-সভাপতি ও সাবেক দুর্যোগ ব্যবস্থপনা ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা: এনামুর রহমান গ্রেফতার হয়ে বর্তমানে জেল-হাজতে রয়েছে।
মামলার দ্রুত নিষ্পত্তির দাবি:
জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের মামলায় রানা প্লাজার মালিক সোহেল রানার বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মামলা ২০১৯ সালে সর্ব শেষ সাভার মডেল থানায় সোহেল রানার বিরুদ্ধে দুদকের সাবেক উপপরিচালক মাহবুবুল আলম বাদী হয়ে মামলা করেন।
জানা যায়, ২ কোটি ২৮ লাখ ৪৩ হাজার ৭৯৩ টাকা জ্ঞাত আয়ের সাথে অসংগতিপূর্ণ অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন সোহেল রানা। সোহেল রানা সাভারের এক চিকিৎসক মোশারফ হোসেনের কাছ থেকে ২ লাখ টাকায় ১০ শতাংশের কিছু বেশি জমি কেনেন। সোহেল সাভার পৌরসভায় ১২তলা ভবন তৈরির জন্য আবেদন করেন। ২০০৮ সালে কাজ শুরু হয়। ২০১৩ সালে আটতলা পর্যন্ত নির্মাণকাজ শেষ হয়।
এদিকে একটি সূত্র জানায়, সোহেল রানার বিরুদ্ধে আরো চারটি মামলা বিচারাধীন এসব মামলায় তিনি কারাগারে আছেন। সম্পদের হিসেব বিবরণী জমা না দেয়ার মামলায় ঢাকার একটি আদালত সোহেল রানাকে তিনবছর কারাদণ্ড দেন।
২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসে পড়লে ২৯ এপ্রিল বেনাপোলে র্যাবের হাতে তিনি গ্রেফতার হন।
বাংলাদেশ গামের্ন্টস অ্যান্ড শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় কমিটি সভাপতি রফিকুল সুজন নয়াদিগন্তকে বলেন, ‘এক যুগ পেরিয়ে গেল রানা প্লাজা শ্রমিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত ব্যক্তিদের মামলার নিষ্পত্তি এবং সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। রানা সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিক এবং পরিবারকে পূর্ণবাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা, দুই হাজারের অধিক আহত পঙ্গু শ্রমিকদের সু-চিকিৎসা দেয়া হয়নি, চিকিৎসার জন্য দ্বারে দ্বারে ঘুরছে শ্রমিকরা।’
এ সময় তিনি রানা প্লাজার জায়গা, ও সম্পদ সরকার অধিগ্রহণ করে একটি হাসপাতাল নির্মাণ করে আজীবন চিকিৎসা প্রদান, এক জীবন আয়ের সমপরিবার ক্ষতিপূরণ প্রদান, রানা প্লাজার সামনে স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করা, ২৪ এপ্রিলকে শ্রমিক শোক দিবস ঘোষণা করার দাবি জানান।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা দাবির বাস্তবায়ন চাই।’
রানা প্লাজা ট্রাজেডির নানা কর্মসূচি :
রানা প্লাজা ট্রাজেডির এক যুগ পূর্তি উপলক্ষে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের উদ্যোগে নানামুখী কর্মসূচি পালন করার খবর পাওয়া গেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ীভাবে নির্মিত শহীদবেদীতে সাভার- আশুলিয়ার- ধামরাইসহ বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরা ও নিহত শ্রমিকদের আত্নীয়-স্বজন সকাল ৯টা হতে দিনব্যাপী ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন, মিছিল, মানবন্ধনসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালন করবে দিন ব্যাপী।
বাংলাদেশ গামের্ন্টস অ্যান্ড শিল্প শ্রমিক ফেডারেশনের কেন্দ্রীয় সভাপতি মো: রফিকুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘বুধবার সন্ধ্যায় রানা প্লাজার সামনে অস্থায়ী শহীদ বেদীতে মোমবাতির প্রজ্জলনের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটির সূচনা হবে।’
২০১৩ সালে ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ট্রাজেডি বিশ্বের একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী শ্রমিক দুর্ঘটনা। ভয়াবহ এ ঘটনায় এক হাজার ১ শ’ ৩৮ জন শ্রমিক নিহত এবং আহত ২ হাজার ৪৩৮ জনকে উদ্ধার করা হয়। কাজের পরিসমাপ্তি করে।
(এই ওয়েবসাইটের যেকোনো কিছু অনুমতি ছাড়া ব্যবহার করা বেআইনি)
© 2025, এশিয়ান অনলাইন টিভি  |  সর্বস্বত্ব সংরক্ষিতDeveloped by Future IT
Recent comments
Latest Comments section by users
No comment available