মধুপুর গড়ের আনারসের পাতারও অর্থনৈতিক অপার সম্ভাবনা
মধুপুর (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি: মধুপুর গড়ের আনারসের পাতাকে ঘিরে তৈরি হয়েছে অর্থনৈতিক সম্ভাবনার নতুন দ্বার। রসালো ফল আনারসের পাতার আঁশ থেকে তৈরি করা যায় নানা শৌখিন হস্ত পণ্য। সুতার নানা জিনিসের মতো তৈরি করা যায় কাপড়সহ নানা সাংসারিক নিত্য প্রয়োজনীয় হস্তশিল্প। যা গুণেমানেও ভালো। দামও অনেক বেশি পাওয়া যায়। দেশ ও দেশের বাইরেও রয়েছে চাহিদা।লাল মাটির গড়ে আনারসের প্রচুর পরিমাণে চাষাবাদ থাকায় কাঁচামাল হিসেবে সহজেই পাওয়া যাবে পাতা। সহজলভ্য হবে। হবে কাঁচামালের আধিক্য। পাতারও বহুমুখী ব্যবহার হয় নানান কাজে। এখনও গ্রামের পর গ্রাম জুড়ে আনারস বিক্রির পর গাছ ফেলে দেয়া হয়। আগাছার মতো ট্রাক্টরে হালচাষ করা হয়। ফেলে দেয়া হয় স্তুপাকার করতে হয় আগাছার মতো। কেউ আবার গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করে। আবার অনেক সময় স্তুপাকার করে পুড়িয়ে দেয়া হয়।বর্তমানে এ পাতা দিয়ে ক্ষুদ্র পরিসরে তৈরি হচ্ছে নানান শৌখিন হস্তপণ্য। বৃহৎ পরিসরে শিল্প হিসেবে আনারস পাতার বহুমুখী ব্যবহার করতে পারলে মধুপুরে গড়ে উঠবে শিল্প কারখানা। বেকারদের হবে কর্মসংস্থান। দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি করতে পারলে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। এজন্য সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে লাল মাটির মধুপুর হয়ে উঠতে পারে সমৃদ্ধ আনারসের ফাইভার জোন। হতে পারে সমৃদ্ধ উন্নত জনপদ। কৃষকরা পাবে আনারস ও পাতার দ্বিমুখী অর্থনৈতিক সুবিধা। টেকসই ও বাড়বে আনারস উৎপাদন। প্রসিদ্ধ টাঙ্গাইলের মধুপুর গড়।জানা গেছে, ‘মেনোনাইট সেন্ট্রাল কমিটি বাংলাদেশ’ নামের একটি বিদেশি সংস্থা প্রথমে আনারসের পাতা থেকে সূতা ও হস্তশিল্প তৈরি শুরু করে। ২০১৭ সালে এসে বনাঞ্চলের জাঙ্গালিয়া গ্রামের নারীদের দিয়ে ব্যুরো বাংলাদেশ নামক বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা হস্তশিল্পের কাজ করে। ফাইবার এক্সট্রাকশন মেশিনের মাধ্যমে আনারস পাতা থেকে আঁশ বের করা হয়। ভাঙা প্লে ও নারিকেলের খোল দিয়ে ঘষে পাতা থেকে আঁশ বের করে পানিতে ধুয়ে সেগুলো রোদে শুকাতে হয়।এ থেকে এক কিলোগ্রাম পাতা থেকে ৬০ সেন্টিমিটার লম্বা শক্ত সুতা পাওয়া যায়। আঁশ বের করার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত প্রায় ৩০ জন মানুষের সাহায্য লাগে। ১ হাজার কেজি পাতা থেকে একশ’ থেকে দেড়শ’ কেজি আঁশ পাওয়া যায়। এ সুতার বিভিন্নমুখী ব্যবহার করা হয়ে থাকে। সুতাগুলো হাতে রশি পাকিয়ে হস্তশিল্প ও গৃহসজ্জার রকমারি জিনিসপত্র বানানো ছাড়াও উন্নতমানের কাপড়ও বানানো যায়। আনারস পাতা থেকে উৎপাদিত সুতা দিয়ে উন্নতমানের লেদার বানানোর কাজে ব্যবহার হয়। যে কারণে দেশের বাইরে রপ্তানি করা যায় বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।আবার যেসব পাতা থেকে সুতা তৈরি করা যায় না, সেগুলো থেকে জুয়েলারি বক্স, টেবিল ম্যাট, ফ্লোর ম্যাট, ফ্লাওয়ার বক্স, ওয়াল হ্যাঙ্গিং, চাবির রিংসহ নানান পণ্য বানানো যায়। শৌখিন এসব পণ্য যাচ্ছে চীনসহ উন্নত দেশগুলোতে। বাড়িতে অলস সময় কাটানোর চেয়ে এসব কাজ করে বাড়তি আয় করছেন অনেকেই।বেরীবাইদ ইউনিয়নের কয়েকজন লোক জানালেন, ফেলনা আনারসের পাতা থেকে এত সুন্দর পণ্য তৈরি হতে পারে তা আমরা আগে জানতাম না। তাদের ইউনিয়নের কিছু নারী এ কাজ করছেন। তাদের মতে, একটি পরিপূর্ণ আনারস গাছে ৩০-৩৬টি পাতা হয়। একটি গাছে একবারই ফল ধরে। ওই গাছের গোড়ায় নতুন কুশি দিয়ে গাছ জন্মায়। আনারস কাটার পর ওই গাছের অন্তত ১৫-২০টি পাতা কেটে ফেলে দেয়া হয়। আর নতুন গাছ হওয়ার পর সব পাতাই কাটা যায়। এই পাতাগুলো নিচে পড়ে নষ্ট হয়। মাটিতেই পচে মিশে যায়। কেউ কেউ গবাদিপশুর জন্যও নিয়ে যান। কিন্তু কয়েক বছর ধরে তাদের এলাকায় কিছু নারী তারা কাজে লাগাচ্ছে। নারী উদ্যোক্তা ও ব্যুরো ক্রাফটের পরিচালক রাহেলা জাকির সাংবাদিকদের বলেন, অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া মানুষদের কর্মসংস্থানের লক্ষ্যে মধুপুরের এ প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। চীনের একটি মেলায় তারা অংশগ্রহণ করে এসব পণ্যের বেশ সাড়া পেয়েছেন। এ ছাড়া আরও অনেক দেশই হস্তশিল্পের এ পণ্যের প্রতি আগ্রহের কথা জানিয়েছে।তিনি আরো বলেন, আনারসের কিছু পাতা আছে যেগুলো দিয়ে আঁশ বানানো সম্ভব হয় না সেগুলো দিয়ে টিস্যু পেপার বকাস তৈরি করছে। আনারসের কোনো জিনিসই আর ফেলনা নয়, ওয়ান টাইম প্লেট ও গ্লাস তৈরির পরিকল্পনা চলছে। পরিত্যক্ত প্রাকৃতিক কাঁচামাল দিয়ে তৈরি পরিবেশবান্ধব এসব পণ্যের দেশের বাইরেও চাহিদা রয়েছে বলে জানান তিনি।মধুপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. জুবায়ের হোসেন বলেন, আনারস জিআই পণ্যের স্বীকৃতি পাওয়ার পর মধুপুর তথা বাংলাদেশকে নতুন নতুন রপ্তানির দ্বার উন্মোচন করছে। একদিকে মধুপুরের সুস্বাদু আনারসের তৈরি পণ্যের কদর যেমন বাড়ছে পিছিয়ে নেই আনারস গাছের পাতাও। আনারসের পাতা দিয়ে সুতা তৈরি করে বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করা সম্ভব। আনারসের পাতার সুতা মূল্যবান কাপড়চোপড় তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।মধুপুর গড়ের লালমাটির প্রধান অর্থনৈতিক ফসল আনারস। বছরের কয়েকমাস আনারস, কয়েকমাস কলা, আদা হলুদসহ নানা কৃষি ফসল সচল রাখে। সরকারি বেসরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে এসব হস্ত পণ্য তৈরির কাজে লাগাতে পারলে অর্থনীতির চাকা আরো গতি পাবে। কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে এ এলাকার বেকার হাজার হাজার নারী পুরুষের। এসব পণ্য বিদেশে রপ্তানি করে দেশ পেতে পারে বৈদেশিক মুদ্রা। সমৃদ্ধ হবে লালমাটির জনপদ। এমনটাই প্রত্যাশা স্থানীয়দের।