একডালা দুর্গ আবিষ্কারের দাবি জাবির গবেষক দলের
সৈকত ইসলাম, জাবি: জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে তাঁর গবেষকদল গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার রায়েদ ইউনিয়নের অন্তর্গত রানীর বাড়ি বা দরদরিয়া দুর্গ নামক স্থানে 'একডালা দুর্গ'র অবস্থান আবিষ্কার করেছেন।১৯ জানুয়ারি শুক্রবার বিকাল সাড়ে চারটায় 'দরদরিয়া দুর্গে প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ ও খননে আবিষ্কৃত প্রত্নবস্তুর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ অনুষ্ঠান'-এ গবেষকদলের প্রধান ও 'ঐতিহ্য অন্বেষণের' নির্বাহী পরিচালক সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বিষয়টি ঘোষণা করেন।'একডালা দুর্গ'র অবস্থান নির্ণয় বাংলাদেশের মধ্যযুগের ইতিহাসে একটি অমীমাংসিত বিষয়। মধ্যযুগে 'একডালা দুর্গ'র অস্তিত্ব ছিল সেবিষয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে কোনো বিতর্ক নেই। কারণ, দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সমসাময়িক ইতিহাসবিদ জিয়াউদ্দীন বারাণীর 'তারিখ-ই-ফিরোজশাহী’ গ্রন্থে একডালা দুর্গের উল্লেখ রয়েছে। তবে এই একডালা দুর্গের অবস্থান নিয়ে ইতিহাসবিদদের মধ্যে রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন মত। কেউ বলেছেন 'একডালা দুর্গ' দিনাজপুরে, কেউ পান্ডুয়ায়, কেউ আবার বলছেন ঢাকা জেলায়। এসব দাবির ক্ষেত্রে কোন ইতিহাসতত্ত্ব মানা হয়নি এবং একডালা দুর্গ'র যে চিত্র এতদিন যাবৎ উপস্থাপিত হচ্ছে সেটিও অনুমান সৃষ্ট বলে জানান সুফি মোস্তাফিজুর রহমান।দিল্লীর সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের সমসাময়িক জিয়াউদ্দীন বারাণীর বিবরণে দেখা যায়, একডালা দুর্গের একদিকে ছিল নদী এবং অন্যদিকে জঙ্গল। একডালা দুর্গ অবরোধের এক পর্যায়ে সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর সৈন্যদের নদী পারাপারের জন্য 'কংখর' (সাঁকো?) তৈরির নির্দেশ প্রদান করেন। প্রাসাদ ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারাণীর একডালা দুর্গের বর্ণনা এবং বর্তমান দরদরিয়া দুর্গের অবস্থান বিশ্লেষণ করলে অনেক মিল পাওয়া যায়। দরদরিয়া দুর্গের পশ্চিমে বানার (শীতলক্ষ্যা) নদী এখনো প্রবহমান। পূর্ব দিকে দু'টি দুর্গ-প্রাচীর এবং দুটি পরিখাও রয়েছে। উপরন্তু দুর্গের পূর্ব, উত্তর-পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব দিকে রয়েছে বিস্তৃত শালবন জঙ্গল।এছাড়া, প্রায় আড়াই শ’ বছর পূর্বে ১৭৭৯ সালে প্রকাশিত 'বেঙ্গল অ্যাটলাসে' জেমস রেনেল একডালার অবস্থান দেখিয়েছেন কাপাসিয়া অঞ্চলে। প্রায় দু'শ বছর পূর্বে জেমস টেলর 'A Sketch of the Topography & Statistics of Dacca' গ্রন্থেও বর্তমান দরদরিয়া দুর্গ এবং 'একডালা দুর্গ অভিন্ন মনে করেন।সার্বিক বিষয় বিশ্লেষণ করে সুফি মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নদী, দ্বি-স্তর দুর্গ, জঙ্গল এবং ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান সব মিলিয়ে দরদরিয়া দুর্গকে প্রাথমিকভাবে 'একডালা দুর্গ' প্রস্তাব করছি। মাঠকর্মে প্রাপ্ত প্রত্নবস্তুর ভিত্তিতে করা আমাদের এই প্রস্তাব আর্মডচেয়ার ইতিহাসবিদ বা প্রত্নতত্ত্ববিদ কিংবা পণ্ডিতদের মধ্যে নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি করবে। কিন্তু চলমান গবেষণায় আরও আবিষ্কার, পরম সময়কাল নির্ণয় এবং গবেষণা সাপেক্ষে আমাদের যুক্তি আরও ক্ষুরধার হবে আশা করছি। যেমনি হয়েছিল আমাদের উয়ারী-বটেশ্বর এবং বিক্রমপুরের কালজয়ী তাৎপর্যপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক আবিষ্কার নিয়ে।’অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী সিমিন হোসেন রিমি বলেন, 'ছোট বেলায় বাবার মুখে শুনেছি, দরদরিয়া মানে দ্বার-ই-দরিয়া অর্থাৎ দরিয়ায় প্রবেশের পথ। বাংলাদেশের অগ্রগতির জন্য ও পর্যটনকে আকৃষ্ট করার জন্য দরদরিয়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্বের অনেক দেশ পর্যটকদের মাধ্যমে বড় রাজস্ব আয় করছে। এটি বাংলাদেশের জন্য উল্লেখযোগ্য প্রত্নতত্ত্ব নিদর্শন আবিষ্কার। এটি বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করবে।'ঐতিহ্য অন্বেষণের সভাপতি ড. নূহ-উল-আলম লেনিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মেসবাহ কামাল। তিনি বলেন, এটিই হতে পারে সেই 'একডালা দুর্গ', যেখানে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াসশাহকে আক্রমণ করতে এসে দিল্লীর সম্রাটকে দুইবার ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে যেতে হয়েছে। ইতিহাস ও ঐতিহাসিক বর্ণনা তা-ই বলে। তবে ইতিহাসবিদদের তর্ক-বির্তকে এটি আরও যাচাই-বাছাই হবে। ইতিহাসের স্পর্শ যেখানে আছে পর্যটক সেখানেই বেশি তৃপ্তি পায়। সুলতানী আমলের এই আবিষ্কার দরদরিয়ার মানুষের গর্বের বিষয়।অনুষ্ঠানে আরও উপস্থিত ছিলেন, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আফরোজা খান মিতাসহ স্থানীয় ব্যক্তিরা।উল্লেখ্য, প্রাথমিক খননে দুর্গের একটি দেয়াল আবিষ্কার হয়েছে। আবিষ্কৃত দেয়ালের একটি অংশে দুর্গ প্রাচীরের অবিচ্ছেদ্য অংশ 'বুরুজ' আবিষ্কৃত হয়েছে, যেটি অর্ধবৃত্তাকার এবং দেয়াল থেকে বাইরের দিকে প্রক্ষিপ্ত। আবিষ্কৃত দুর্গের খননকার্য চলমান।