গণিত বইয়ের শ্রমিকেরা অর্ধেক কাজ করে চলে যেত কেন?
তামান্না আক্তার: শৈশবের যোগ-বিয়োগের কাটাকাটি সেরেছেন আর শ্রমিকেরা অর্ধেক কাজ রেখে চলে যাওয়ার অংক কষেননি এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া ভার। শুধু তাই নয়, ছাত্রাবাসের ছাত্ররা হুটহাট কোথায় চলে যেত আবার নতুন ছাত্র আসতো, তাদের খাওয়া-দাওয়ার খরচের হিসাব রেখেছি আমরা। আবার কোনো এক বোকা চৌবাচ্চার একটি নল দিয়ে পানি ভরে আরেকটি নল খুলে রেখে দেয়। এদিকে মাঝি তার নৌকা নিয়ে স্রোতের প্রতিকূলে দাঁড় বেয়ে ঠিক কোথায় যেত সেই হিসাবও মিলে না আমাদের। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো কি নিতান্তই মজার ছলে অংক কষার জন্য? উত্তরটি হচ্ছে 'না'।শৈশবের পাঠ্যবইয়ের এসব অংক নিয়ে আমাদের এই প্রজন্মের এখন বিনোদনের খোরাক হলেও এর পেছনে রয়েছে নিগূঢ় বাস্তবতা। কথা বলা যাক অর্ধেক শ্রমিকের কাজ রেখে চলে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে। হিউম্যান রিসোর্সের ভাষায় এটিকে বলে 'এমপ্লয়ি টার্নওভার'। অর্থাৎ, টার্নওভার বলতে এমন কর্মীদের বোঝায়, যারা তাদের কর্মরত প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যায়। টার্নওভারের হার হলো মোট কর্মীর শতাংশ, যারা একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠান থেকে চলে যায়। বৃহত্তর ইন্ডাস্ট্রিগুলো একটি আর্থিক বা ক্যালেন্ডার বছরে তাদের টার্নওভারের হার পরিমাপ করে থাকে।বাংলাদেশ তথা এশিয়ার প্রেক্ষিতে এমপ্লয়ি টার্নওভার কালচার যেন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। এটি অনেক দেশের এইচআর ম্যানেজারদের দুশ্চিন্তার কারণ, অনেককে তো ঘুমহীন রাতও কাটাতে বাধ্য করে। কর্মী ধরে রাখার তুলনায় কর্মী প্রতিস্থাপন বেশি ব্যয়বহুল। এজন্য পুরো নিয়োগ প্রক্রিয়া পুনরায় শুরু করতে হয়। ফলে সময় এবং অর্থ দুটোই বেশি খরচ হয়। একসাথে অনেক কর্মী কাজ ছেড়ে গেলে প্রতিষ্ঠানের ওপরও অনেক বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। আমাদের পাঠ্যবইয়ের শ্রমিকদের চলে যাওয়ার অংকের উৎপত্তি মূলত এই বাস্তব ধারণা থেকেই।এবার আসা যাক কেন তারা চলে যায় সেই বিষয়ে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে শতকরা ৬৭ শতাংশ কর্মী স্বল্প বেতনের কারণে চাকরি ছেড়ে যায়। অর্থাৎ, কর্মীরা যখন তার কর্মরত প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে বেশি বেতন পায়, তখন চলে যায়। আবার প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নানান অসন্তোষের ফলও তাদের চলে যাওয়ার কারণ। উক্ত গবেষণা থেকে উঠে আসা আরেকটি ভয়ঙ্কর তথ্য হচ্ছে শতকরা ৫১ শতাংশ কর্মী যৌন হয়রানির শিকার হয়ে চাকরি পাল্টাতে বাধ্য হয়। তাদের বেশিরভাগই নারী কর্মী।আবার কোনো কোনো কাজে প্রমোশনের সুযোগ খুবই কম থাকে কিংবা জটিল প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হয়, তখন ভালো সুযোগ-সুবিধা ও প্রমোশন পেতে শ্রমিকেরা অন্য প্রতিষ্ঠানে চলে যায়। গবেষণায় দেখা গেছে, প্রতি ১০০ জনের ৫৬ জন কর্মী প্রমোশনের সুযোগ না পাওয়ায় কাজ ছেড়ে দেয়। কর্মী টার্নওভারের জন্য দায়ী এরকম অগণিত কারণ আছে। দুর্ভাগ্যবশত, এশিয়ায় কর্মীদের টার্নওভার এত গুরুতর সমস্যা হওয়া সত্ত্বেও, এটি নিয়ে পর্যাপ্ত গবেষণার অভাব রয়েছে।কর্মীদের টার্ন ওভার কালচার কমিয়ে আনতে এর কারণ উদঘাটন করতে হবে এবং সেই অনুযায়ী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, প্রতিযোগিতামূলক বেতন এবং সুবিধাদি প্রদান করে কর্মীদের সন্তুষ্টি নিশ্চিত করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কর্মীরা যদি মনে করে তাদের পরিশ্রমের যথার্থ মূল্যায়ন করা হচ্ছে, তাহলে তারা প্রতিষ্ঠানের প্রতি আরও বিশ্বস্ত এবং নিবেদিত থাকবে। দ্বিতীয়ত, একটি সহায়ক এবং বন্ধুত্বপূর্ণ কর্মপরিবেশ তৈরি করা প্রয়োজন। যেখানে কর্মীরা স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারে, তাদের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং সমঝোতার সম্পর্ক বজায় থাকে, সেখানে কর্মীরা অনেক বেশি প্রোডাক্টিভ এবং সুখী থাকে। তৃতীয়ত, নিয়মিত প্রশিক্ষণ এবং উন্নয়নের সুযোগ প্রদান করতে হবে। এর ফলে কর্মীদের দক্ষতা বাড়বে এবং তারা ক্যারিয়ার উন্নয়নে উৎসাহী হবে।কর্মীদের ভালো কাজের স্বীকৃতি প্রদান এবং পুরস্কৃত করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এটি তাদের মনোবল বৃদ্ধি করে এবং প্রতিষ্ঠান থেকে তাদের বিচ্ছিন্ন হওয়ার প্রবণতা কমায়। পাশাপাশি, কর্মজীবন এবং ব্যক্তিগত জীবনের মধ্যে একটি ভালো ব্যালেন্স বজায় রাখতে সহায়তা করা উচিত, যেমন ফ্লেক্সিবল ওয়ার্কিং আওয়ার এবং রিমোট ওয়ার্কের সুযোগ প্রদান। এই সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠান এবং কর্মীদের মধ্যে একটি শক্তিশালী এবং দীর্ঘমেয়াদী সম্পর্ক গড়ে তোলা সহজ হয়। ফলে গণিত বইয়ের শ্রমিকেরা কাজ শেষ করুক আর না করুক আপনার প্রতিষ্ঠানের কর্মী টার্নওভার কমানোর ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করা সম্ভব।লেখক: শিক্ষার্থী, ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।