নরসুন্দরদের সেকাল-একাল
ভালুকা (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি: কালের বিবর্তন ও আধুনিকতার ছোঁয়ায় পরিবর্তন এসেছে নরসুন্দরদের কার্যপদ্ধতিতে। ময়মনসিংহের ভালুকা উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চলে নরসুন্দররা নাপিত নামে পরিচিত। একসময় উপজেলার ১১টি ইউনিয়নের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এরা পেশাগত কাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো। কয়েকদশক আগেও নরসুন্দররা সকাল হলেই গ্রামের মেঠোপথ ধরে কাপড় দিয়ে বানানো খতিতে (সেলাই ছাড়া ব্যাগ) ক্ষুর, কেঁচি, সান দেয়ার পাথর, সাবান, ফিটকারীসহ প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে ছুটে চলত খদ্দেরের আশায়। এখন গ্রামের সাপ্তাহিক হাট বার ছাড়া তাদেরকে তেমন একটা দেখা যায় না।বর্তমান সময়ে খদ্দেররা সুন্দর হয়ে উঠার সময়টুকু আরাম আয়েশে কাটাতে চায়। চায় আধুনিক উপকরণের ছোঁয়া। খদ্দেরের চাহিদাকে মাথায় রেখে দেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অত্যাধুনিক সেলুন। আধুনিক সেলুন শুধু অভিজাত শহরেই নয় ক্রমান্বয়ে জেলা, উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন পর্যায়ের হাট-বাজারেও চলে এসেছে। এখন গ্রামের হাট-বাজারে গদিমোড়া চেয়ার, বাঁধানো আয়না, মাথার উপরে ঘুরতে থাকা বৈদ্যুতিক পাখা, ফোম, ক্রীম, সুবাসিত লোশনসমৃদ্ধ চুল কাটানো, সেইভ করার সেলুনের প্রতি আগ্রহ সবার। তবে এখনও সাপ্তাহিক গ্রামীণ হাট-বাজারে চোখে পড়ে সাবানের ফেনা মুখে মেখে দাড়ি কামানো, ছোট বাটিতে পানি নিয়ে পাথরে বা মোটা চামড়ায় ঘষে ক্ষুরের ধার তোলা নরসুন্দরদের।ভালুকা উপজেলার বরাইদ গ্রামের নরসুন্দর অরুন চন্দ্র শীল (৬০) জানান, স্বাধীনতার পর থেকেই তিনি এ পেশায় নিয়োজিত রয়েছেন। সপ্তাহে শনিবার মল্লিকবাড়ি, বুধবার বান্দিয়া, সোম ও শুক্রবার তিনি মেদুয়ারী বাজারে কাজ করে থাকেন। জমা, মেথর ও চা-পান খরচ বাদে প্রতি হাট বারে ৪০০-৫০০ টাকা তার আয় হয়। এছাড়া অন্যান্য দিন গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে থাকেন। এতে যা আয় হয় তাতে কোনো রকমে খেয়ে না খেয়ে বেঁচে আছেন।পার্শ্ববর্তী ত্রিশাল উপজেলার আমিরাবাড়ি গ্রামের অপর এক নরসুন্দর রায়মোহন চন্দ্র শীল (৬৬) জানান, কয়েক দশক আগেও একেকটি এলাকায় নির্দিষ্ট করে একজন নরসুন্দর কাজ করতেন। ওই সময় সারা বছরের পারিশ্রমিক ধান দিয়ে বছরে একবার পরিশোধ করা হত। শুধু নবান্নের সময় এ পারিশ্রমিক দেয়া হত। নরসুন্দররা একাধারে কয়েকদিন তাদের নির্দিষ্ট এলাকায় অবস্থান করে পারিশ্রমিক তুলে ফিরে আসত নিজ বাড়িতে। নরসুন্দরদের এ রেওয়াজ আজ শুধুই ইতিহাস। ক্রমেই এ পেশায় পরিবর্তন শুরু হয়। বছরে মাত্র একবারের পরিবর্তে নগদায়নের মাধ্যমে পারিশ্রমিক নেয়ার রেওয়াজ শুরু হয়। আস্তে আস্তে গ্রামের মানুষের সঙ্গে নরসুন্দরদের সংযোগ বিচ্ছিন্ন হতে থাকে। বর্তমানে সবাই সেলুনমুখী হওয়ায় আমরা আর আগের মত কাজ পাচ্ছি না।