• ঢাকা
  • |
  • রবিবার ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বিকাল ০৪:০৫:৪৮ (24-Nov-2024)
  • - ৩৩° সে:
এশিয়ান রেডিও
  • ঢাকা
  • |
  • রবিবার ১০ই অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বিকাল ০৪:০৫:৪৮ (24-Nov-2024)
  • - ৩৩° সে:

আত্মসমালোচনাই মনুষ্যত্ব বিকাশের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম

মো. কামাল উদ্দিন: মানবজাতিকে আল্লাহ তায়ালা আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব হিসাবে সৃষ্টি করেছেন এবং দিয়েছেন স্বাধীন চিন্তাশক্তি। মানুষকে স্বাধীন চিন্তা শক্তি দেওয়ার ফলে তাদের মধ্যে কয়েক ধরনের নফসের সম্মিলন ঘটেছে। নফসে আম্বারাহ (প্রতারক আত্মা)। অর্থাৎ যে নফস মানুষকে কুপ্রবৃত্তি ও জৈবিক কামনার দিকে আকৃষ্ট করে। নফসে লাওয়ামাহ (অনুশোচনাকারী আত্মা)। যে নফস অন্যায় করার পর মানুষের হৃদয়ে অনুশোচনার উদ্রেক করে। নফসে মুতমায়িন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা)। যে নফস সকল কালিমা থেকে মুক্ত এবং যাবতীয় মহৎ ভাবনায় পরিতৃপ্ত।নফসে মুলহিমাহ- এই প্রকৃতির নফসকে আল্লাহ্‌ তায়ালা ভাল মন্দের ইলহাম করে তার নফস তুলনামূলক ভাবে নফসে লাওয়্যামার চেয়ে ভাল। এর মধ্যে নফসে আম্মারাহ বা কুপ্রবৃত্তি মানুষকে জৈবিক কামনা-বাসনা ও দুনিয়ার লোভ-লালসার দিকে আকৃষ্ট করে তাকে মন্দ কাজের দিকে নিয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, নিশ্চয়ই মানুষের মন মন্দ কর্মপ্রবণ। কিন্তু সে মন নয়, আমার পালনকর্তা যার প্রতি অনুগ্রহ করেন (ইউসুফ : ৫৩)। অধিক হারে মন্দকাজ বান্দার অন্তরকে কঠিন করে তোলে ও ইসলাম থেকে দূরে সরিয়ে দেয়। রাসুল (সা.) বলেছেন, যখন বান্দা কোন পাপ করে তখন তার অন্তরে কালো দাগ পড়ে যায়। যখন সে তওবা করে তখন তা তুলে নেওয়া হয়। আর ইস্তেগফারের মাধ্যমে অন্তরকে পরিষ্কার করা হয়। আর যদি পাপ বাড়তেই থাকে তাহলে দাগও বাড়তে থাকে। আর এটাই হল মরিচা। (তিরমিযী : ৩৩৩৪; মিশকাত : ২৩৪২)। যেমন আল্লাহ  তায়ালা বলেন, বরং তাদের কৃতকর্মের ফলেই মনের উপর মরিচা জমে গেছে (মুতাফফিফিন : ১৪)।দুনিয়াতে প্রতিটি মানবসত্তাই মন্দ কাজে লিপ্ত হয়ে থাকে। তাই তা থেকে বেঁচে থাকার জন্য আত্মসমালোচনা একান্ত প্রয়োজন। প্রতিদিন মানুষ নিজেই নিজের পাপের হিসাব নেওয়ার মাধ্যমে পুনরায় ঐ পাপে লিপ্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে পারে। এছাড়া ব্যক্তির মাঝে যে পাপবোধ সৃষ্টি হয় আত্মসমালোচনা তাকে ক্ষমা লাভের উপযুক্ত করে তোলে। একমাত্র আত্মসমালোচনার দ্বারাই নিজের কুপ্রবৃত্তি দমন করে মনুষ্যত্ব বৃদ্ধি করে । আত্মসমালোচনার অর্থ নিজের বিরুদ্ধে নিজেই সমালোচনা করা। নিজের কর্মের সাদৃশ্য-বৈসাদৃশ্য নির্ণয় করা। অর্থাৎ আত্মজিজ্ঞাসার মাধ্যমে নিজের ত্রুটি-বিচ্যুতিগুলো চিহ্নিত করে তা সংশোধনের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত নিজেকে উন্নত থেকে উন্নততর স্তরের নিয়ে যাওয়ার যে প্রক্রিয়া তার নামই হল আত্মসমালোচনা। অন্যের সমালোচনা করা কাজটা যত সহজ, নিজের সমালোচনা করা কিন্তু ততটা সহজ নয়।ব্যক্তিগতভাবে আত্মসমালোচনা আমার কাছে আয়নার মতো মনে হয়। আয়নায় আমরা যেমন আমাদের প্রতিবিম্ব দেখতে পাই, আমাদের শরীরে, মুখে কোথায় কী আছে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখি, ঠিক তেমনি আমাদের প্রাত্যহিক কার্যাবলি ঠিক না বেঠিক তা আত্মসমালোচনার মাধ্যমে বুঝতে পারি। দুই চোখ দিয়ে মানুষ অন্যকে এবং অন্যের দোষ-ত্রুটি দেখতে পায়। কিন্তু অন্তরের চোখে নিজের আয়নায় নিজেকে দেখতে পায়। পরকালীন জবাবদিহিতার প্রতি লক্ষ্য রেখে নিজের ভালো-মন্দ নিয়ে নিজের সঙ্গে প্রতিনিয়ত বোঝাপড়া করার নাম আত্মসমালোচনা। নিন্দাসূচক সমালোচনা করা আমাদের এমন একটি নিয়মিত অভ্যাস যা থেকে বেঁচে থাকতে পারেন এমন ব্যক্তির সংখ্যা সমাজে খুবই কম। মজার ব্যাপার যে, এই আমাদেরই একজনকেও খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি নিজের সমালোচনা শুনতে আগ্রহী। অথচ জ্ঞাতে-অজ্ঞাতে আমরা প্রতিনিয়তই অন্যের সমালোচনা করি, আবার নিজেরাও একইভাবে অন্যের সমালোচনার শিকার হই। প্রাত্যহিক জীবনে সামান্য অবসর পেলেই আমরা তা অন্যের সমালোচনা বা নিন্দায় অতিবাহিত করার সুযোগ হাতছাড়া করি না। অথচ আল্লাহ তা’আলা পবিত্র কুরআনের সূরা হুজুরাতের ১২ নং আয়াতে যে কোন গিবত তথা নিন্দাবাচক সমালোচনা থেকে বিরত থাকার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহ তা’আলা বলেন, হে ইমানদারগণ ! তোমরা অধিক ধারণা করা থেকে বেঁচে থাক। নিশ্চয় কতিপয় ধারণা গুনাহ এবং তোমরা গোপনীয় বিষয় সন্ধান করো না। আর তোমাদের কেউ যেন কারো পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভ্রাতার গোশত ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুত তোমরা একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও পরম দয়ালু’ (হুজুরাত : ১২)।ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা হজরত ওমর (রা.) আত্মসমালোচনা সম্পর্কে চমৎকার একটি কথা বলেছেন। তিনি বলেন, তোমরা নিজেদের আমলনামার হিসাব নিজেরাই গ্রহণ করো, চূড়ান্ত হিসাব দিবসে তোমাদের কাছ থেকে হিসাব গৃহীত হওয়ার আগেই। আর তোমরা তোমাদের আমলনামা মেপে নাও চূড়ান্ত দিনে মাপ করার আগেই। কেননা, আজকের দিনে নিজের হিসাব নিজেই গ্রহণ করতে পারলে আগামী দিনের চূড়ান্ত মুহূর্তে তা তোমাদের জন্য সহজ হয়ে যাবে। তাই সেই মহাপ্রদর্শনীর দিনের জন্য তোমরা নিজেদেরকে সুসজ্জিত করে নাও, যেদিন তোমরা (তোমাদের আমলসহ) উপস্থিত হবে এবং তোমাদের কিছুই সেদিন গোপন থাকবে না। (তিরমিজি-২৪৫৯, সনদ মওকুফ সহিহ)।এ সম্পর্কে হাসান বসরি (রহ) বলেন, মুমিন ব্যক্তিকে স্বীয় আত্মার পরিচালক হিসেবে আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই আত্মসমালোচনা করতে হবে। যারা দুনিয়াতে আত্মসমালোচনা করবে, কিয়ামতের দিন অবশ্যই তাদের হিসাব হালকা হবে। আর যারা এ থেকে বিরত থাকবে, কিয়ামতের দিন তাদের হিসাব কঠিন হবে। (ইগাছাতুল লাহফান (মাকতাবাতুল মা’আরিফ, তাবি ১/৭৯)।আত্মসমালোচনার মাধ্যমে নিজের দোষ-ত্রুটি নিজের সামনে প্রকাশ করার মাধ্যমে মানুষ স্বীয় ভুল-ত্রুটি জানতে পারে। ফলে তার হৃদয় ভালো কাজের দিকে আকৃষ্ট হয় এবং মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকতে পারে। আত্মসমালোচনা দ্বিনের ওপর দৃঢ়তা অর্জনের সবচেয়ে কার্যকরী মাধ্যম, যা মানুষকে আল্লাহর দরবারে মুহসিন ও মুখলিস বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত করে। আত্মসমালোচনার মাধ্যমে মানুষ আল্লাহর নিয়ামতসমূহ, অধিকারসমূহ জানতে পারে। আর সে যখন আল্লাহর নিয়ামত ও তার অবস্থান সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করে, তখন সে আল্লাহর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায়ে উদ্বুদ্ধ হয়।আত্মসমালোচনার মূল উদ্দেশ্য হলো নাফস তথা আত্মাকে সংস্কার, সংশোধন, পরিশুদ্ধ ও পবিত্র করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন : “হে ইমানদারগণ! তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; আর প্রত্যেকের উচিত চিন্তা করে দেখা আগামী কালের জন্য সে কী অগ্রিম পাঠিয়েছে। আর তোমরা আল্লাহর তাকওয়া অবলম্বন কর; তোমরা যা কর নিশ্চয় আল্লাহ্ সে সম্পর্কে সবিশেষ অবহিত (আল-হাশর : ১৮)। আল্লাহ তায়ালা আরও বলেন, তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে ফিরে আস, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পার। (সূরা আন-নূর, আয়াত: ৩১)। রাসূল(স) : (কখনও কখনও) আমার অন্তরের উপর পর্দা ফেলা হয়; আর আমি দৈনিক একশতবার আল্লাহর নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করি (মুসলিম : ৭০৩৩)। হজরত ওমর ফারুক (রা) বলেন তোমরা হিসাবের মুখোমুখি হওয়ার পূর্বেই তোমাদের নিজেদের হিসাব নিজেরা নিয়ে নাও। (আর এই অর্থে ইমাম তিরমিযী রহ. হাসান সনদে নবি (স.) থেকে হাদিস বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন: বুদ্ধিমান সেই ব্যক্তি, যে তার নফসের হিসাব নেয় এবং মৃত্যুর পরবর্তী জীবনের জন্য কাজ করে; আর দুর্বল ঐ ব্যক্তি, যে নিজের নফসের কুপ্রবৃত্তির অনুসরণ করে এবং আল্লাহর কাছেও আশা-আকাঙ্ক্ষা রাখে” (তিরমিজি : ২৪৫৯)। আর যখন রাতের আগমন ঘটত, তখন হজরত ওমর ফারুক (রা) দোর্রা বা লাঠি দিয়ে তাঁর দু’পায়ে পিটাতেন এবং নিজেকে প্রশ্ন করে বলতেন: তুমি আজকে কী কাজ করেছ? (উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২১)। হজরত আবূ তালহা (রা) কে যখন তাঁর বাগান তাঁর সালাত আদায় করার বিষয়টিকে ভুলিয়ে রাখল, তখন তিনি বাগানের অংশবিশেষ আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যে সাদকা করে দিলেন; সুতরাং তিনি এ কাজটি করেছিলেন শুধু তাঁর আত্মসমালোচনার কারণেই এবং নিজকে তিরস্কার স্বরূপ ও আত্ম-সংশোধনের জন্য।(বর্ণনাটি সহিহ হাদিসে বর্ণিত (উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২১ )। আহনাফ ইবন কায়েস সম্পর্কে বর্ণিত আছে : তিনি চেরাগের নিকট আসতেন, তারপর তিনি তাঁর আঙুল চেরাগের মধ্যে ধরে রাখতেন ততক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ না তিনি আগুনের উত্তাপ অনুভব করতেন; অতঃপর তিনি নিজেকে উদ্দেশ্য করে বলতেন: হে হুনায়েফ! অমুক দিন তুমি যে কাজ করেছ, তা করতে তোমাকে কিসে উদ্বুদ্ধ করেছে? অমুক দিন তুমি যে কাজ করেছ, তা করতে তোমাকে কিসে উত্তেজিত করেছে? (উদ্ধৃত, আবূ বকর আল-জাযায়েরী, মিনহাজুল মুসলিম, পৃ. ১২১)।এভাবেই এ উম্মতের সৎকর্মশীল বান্দাগণ নিজেদের অবহেলার ব্যাপারে আত্মসমালোচনা করতেন, ভুলত্রুটির জন্য নিজেকে নিজে তিরস্কার করতেন, নিজের ‘নাফস’-এর জন্য তাকওয়ার বিষয়টিকে অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য বিষয় বলে ধারণ করতেন এবং তাকে নিজের খেয়াল-খুশি মত চলা থেকে বিরত রাখতেন। কারণ, আল্লাহ তায়ালা বলেন: “আর যে তার রবের অবস্থানকে ভয় করে এবং কুপ্রবৃত্তি হতে নিজকে বিরত রাখে; জান্নাতই হবে তার আবাসস্থল” (আন-নাযি‘আঁত : ৪০– ৪১)।আলোচনায় প্রতীয়মান হয় যে, আত্মসমালোচনা আমাদের পার্থিব জীবনে দায়িত্বশীলতা সৃষ্টি করে, পরকালীন জবাবদিহিতার চিন্তা বৃদ্ধি করে এবং বিবেককে শানিত করে। করণীয় ও বর্জনীয় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা লাভে সাহায্য করে। সর্বোপরি জীবনের উচ্চতম লক্ষ্যকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে একজন প্রকৃত মানুষ হয়ে গড়ে উঠার কাজে সর্বদা প্রহরীর মতো দায়িত্ব  একমাত্র আত্মসমলোচনাই মানুষের মনুষ্যত্ব বিকাশ করে শান্তিময় সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখে। সর্বোপরি পরকালীন মুক্তি নিশ্চিত করে। অতএব আসুন! আমরা নিজেদেরকে একজন প্রকৃত মানুষ হিসেবে, প্রকৃত মুসলমান হিসেবে গড়ে তোলার জন্য জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপ সতর্কতার সঙ্গে চলি।আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে পূর্ণ মুমিন হওয়ার তাওফিক দান করুক। (আমিন)(লেখক: মো. কামাল উদ্দিন, লেকচারার, ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগ, আতাকরা কলেজ, কুমিল্লা, বাংলাদেশ)