হেপাটাইটিস সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রয়োজন জনসচেতনতা
ডা. মুহাম্মাদ মাহতাব হোসাইন মাজেদ: রোববার বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস (World Hepatitis Day 2024)। হেপাটাইটিস সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে প্রতি বছর ২৮ জুলাই দিনটি পালন করা হয় । তবে, আজকের দিনটিই কেন বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস, জানেন ? কারণ, ২৮ জুলাই ডা. বারুচ ব্লুমবার্গের জন্মদিন । তিনিই প্রথম হেপাটাইটিস বি (Hepatitis B) ভাইরাস আবিষ্কার করেছিলেন ।হেপাটাইটিস কী ?হেপাটাইটিস আসলে লিভারের সংক্রমণ। হেপাটাইটিসকে পাঁচভাগে ভাগ করা হয় । হেপাটাইটিস এ, বি, ছি, ডি এবং ই । প্রতিটি ভাইরাল হেপাটাইটিসের জন্য বিভিন্ন ভাইরাস দায়ী ।দেশে হেপাটাইটিস বি ও ছি ভাইরাস খুবই বিপজ্জনক হয়ে উঠছে। প্রতি বছর প্রায় ২২ হাজার রোগী মারা যায়। হেপাটাইটিস সংক্রমণ ক্রমে করোনা মহামারির মতো প্রকট হচ্ছে। সম্প্রতি প্রকাশিত বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) প্রতিবেদন অনুযায়ী, উচ্চঝুঁকিতে থাকা ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম। প্রথমে রয়েছে চীন এবং দ্বিতীয় ভারত। এমন পরিস্থিতিতে নতুন প্রজন্মের সংক্রমণ ও মৃত্যু ঠেকাতে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পাশাপাশি সুচিকিৎসার সুযোগ বাড়ানোর প্রয়োজন। বাংলাদেশে সব বয়সী ৮৩ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস বি ও ছি রোগে আক্রান্ত। এদের মধ্যে ৭২ লাখ রোগী হেপাটাইটিস বি ও ১০ লাখ ২০ হাজার রোগী হেপাটাইটিস সি’তে আক্রান্ত। দুই ধরনের হেপাটাইটিসে আক্রান্তের হার ২ দশমিক ৭ শতাংশ।শীর্ষে থাকা চীনে দুই ধরনের হেপাটাইটিস রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ৮ কোটি ৩৮ লাখ ও আক্রান্তের হার ২৭ দশমিক ৫ শতাংশ, দ্বিতীয় অবস্থানে থাকা ভারতে রোগীর সংখ্যা ৩ কোটি ৫৩ লাখ ও আক্রান্তের হার ১১ দশমিক ৬ শতাংশ ও তৃতীয় অবস্থানে থাকা ইন্দোনেশিয়ায় ১ কোটি ৮৯ লাখ ও আক্রান্তের হার ৬ দশমিক ২ শতাংশ। বাংলাদেশের এক ধাপ ওপরে থাকা পাকিস্তানে রোগীর সংখ্যা ১ কোটি ২৬ লাখ ও আক্রান্তের হার ৪ দশমিক ৪ শতাংশ। তালিকার সবার নিচে থাকা রাশিয়ায় রোগীর সংখ্যা ৪৩ লাখ ও আক্রান্তের হার ১ দশমিক ৪ শতাংশ।অবশ্য শুধু হেপাটাইটিস বি রোগের উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ৯ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। এ তালিকার শীর্ষে আছে চীন। এরপর ভারত ও ইন্দোনেশিয়া। সবার নিচে পাকিস্তান।তবে শুধু হেপাটাইটিস ছি রোগের উচ্চঝুঁকিপূর্ণ ১৫ দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান দশম। এ তালিকার শীর্ষে রয়েছে পাকিস্তান। এরপর ভারত ও চীন। তালিকার সবার নিচে রয়েছে মালয়েশিয়া।সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, সারা বিশ্বে হেপাটাইটিস বি ও ছি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩০ কোটি ৪০ লাখ। এর মধ্যে ২৫ কোটি ৪০ লাখ হেপাটাইটিস বি ও ৫ কোটি হেপাটাইটিস ছি ভাইরাস বহন করছে। ভাইরাসটিতে আক্রান্তদের অর্ধেকের বয়স ৩০ থেকে ৫৪ বছর। আক্রান্তদের মধ্যে ৫৮ শতাংশ পুরুষ এবং ১২ শতাংশ শিশু।সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে ১৮৭টি দেশের নতুন তথ্যে দেখা গেছে, ২০১৯ সালে ভাইরাল হেপাটাইটিসে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ১১ লাখ। ২০২২ সালে তা বেড়ে ১৩ লাখে দাঁড়িয়েছে। হেপাটাইটিস সংক্রমণে বিশ্বব্যাপী প্রতিদিন ৩ হাজার ৫০০ মানুষ মারা যাচ্ছে। এর মধ্যে হেপাটাইটিস বি-তে মারা যাচ্ছে ৮৩ শতাংশ এবং হেপাটাইটিস সি’তে ১৭ শতাংশ।প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালের শেষ নাগাদ দীর্ঘস্থায়ী হেপাটাইটিস বি আক্রান্তদের মধ্যে মাত্র ১৩ শতাংশ শনাক্ত হয়েছে এবং ৩ শতাংশ অ্যান্টিভাইরাল চিকিৎসা পেয়েছে। ২০১৫ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত ৩৬ শতাংশ ডায়াগনসিস হয়েছে এবং ২০ শতাংশ ওষুধ পেয়েছে। ২০২২ সাল নাগাদ ৭০ লাখ মানুষ হেপাটাইটিস বি চিকিৎসা পেয়েছে ও ১ কোটি ২৫ লাখ হেপাটাইটিস ছি চিকিৎসা পেয়েছে, যা ২০৩০ সালের মধ্যে রোগটি নিয়ন্ত্রণে বৈশ্বিক লক্ষ্যমাত্রার অনেক কম।এটা এমন ভাইরাস মানবদেহে চুপ করে বসে থাকে। আস্তে আস্তে ভয়ংকর রূপ নেয়। পরবর্তী সময়ে লিভার সিরাসিস ও ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। মানুষের মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি ও চিকিৎসাসেবার সুলভ ব্যবস্থা করা দরকার।হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আক্রান্তের হার সবচেয়ে বেশি ৩০ থেকে ৫৪ বছর বয়সীদের। অর্থাৎ কর্মক্ষেত্রে প্রবেশের সময় জওৌবেশি আক্রান্ত হয়। বোঝার আগেই সব কিছু শেষ হয়ে যায়। নীরব ঘাতকের মতো। এই বয়সীরা মারা যাওয়ায়, ঐ পরিবারও চরম আর্থিক সংকটে পড়ে। এছাড়া ব্যয়বহুল চিকিৎসাসেবা চালাতে গিয়েও সর্বস্বান্ত হচ্ছে অনেক পরিবার। তাই আমাদের সময় থাকতে এখনি প্রস্তুতি নিতে হবে।হেপাটাইটিসের সাধারণ লক্ষণ:তীব্র হেপাটাইটিসে যাঁরা আক্রান্ত হন, তাঁদের যে প্রধান লক্ষ্যগুলি দেখা যায়, সেগুলি হল ক্লান্তি, ফ্লু-এর মতো উপসর্গ, পেটে ব্যথা, জ্বর, গাঢ় প্রস্রাব, খিদে কমে যাওয়া, ত্বক ও চোখ হলুদ হয়ে যাওয়া, ওজোন কমে যাওয়া ।বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসের তাৎপর্য:হেপাটাইটিস কী,এর লক্ষ্ণণ কী, কীভাবে প্রতিরোধ করা যায়, ঠিক সময়ে চিকিৎসা না করা হলে কী কী হতে পারে, সেইদিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করা, হেপাটাইটিসের ঝুঁকি এবং প্রভাব সম্পর্কে মানুষকে অবগত করানোর জন্য ও সাবধান করার লক্ষ্যেই দিনটি পালন করা হয় ।কেন ২৮ জুলাই বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয় ?বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবসটি প্রতি বছর ২৮ জুলাই ডা. বারুচ ব্লুমবার্গের জন্মদিন উপলক্ষ্যে পালন করা হয় । তিনি ১৯৬৭ সালে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস আবিষ্কার করেন । আর তার দুই বছর পরে প্রথম হেপাটাইটিস বি ভ্যাকসিন তৈরি করেন । তাঁর এই কৃতিত্বের জন্য ১৯৭৬ সালে মেডিসিনে নোবেল পুরস্কার পান ।যেভাবে হেপাটাইটিস রোগ হয়:অনিরাপদ রক্ত ( পেশাদার ডোনার), সিরিঞ্জ, দৈহিক মিলন, মাদকাসক্ত, একই সিরিঞ্জের মাধ্যমে ড্রাগের ব্যবহার, অনিরাপদ আকুপাঞ্চার, মা থেকে নবজাতকের ছড়াতে পারে। এছাড়া টুথব্রাশ ও সেভিংয়ের উপকরণের মাধ্যমে ছড়াতে পারে।হেপাটাইটিস বি দুরকম হয়, অ্যাকিউট এবং ক্রনিক। তফাত কী? অ্যাকিউট হেপাটাইটিস হয় সাধারণত প্রাপ্তবয়স্কদের। তাঁদের শরীরে কোনও ভাবে ভাইরাসটি ঢুকলে জ্বর, জন্ডিস, খিদে কমে যাওয়া, সাদা মল, গা-বমি ভাব, হলুদ প্রস্রাব-- এই সব উপসর্গ দেখা দেয় রোগীর শরীরে। শরীরে ভাইরাস ঢোকার ৬ সপ্তাহ থেকে ৬ মাস পরেও দেখা দিতে পারে উপসর্গ। সংক্রমণের প্রথম ১ মাস থেকে ৩ মাস উপসর্গের তীব্রতা থাকে বেশি। আর ৬ মাসের মধ্যে সাধারণত নির্মূল হয়ে যায় ভাইরাস। তার পরে শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যায়।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতিদিন প্রায় ৪ হাজার মানুষ এবং প্রতি ৩০ সেকেন্ডে এক জন হেপাটাইটিস বি ও ছি—এই দুই ভাইরাসের কারণে মৃত্যুবরণ করে। তবে এই দুটি প্রাণঘাতী ভাইরাস হলেও প্রতিরোধযোগ্য।>কারণ* ভাইরাস- হেপাটাইটিস ' এ ' ভাইরাস; হেপাটাইটিস ' বি ' ভাইরাস ; হেপাটাইটিস ' ছি' ভাইরাস ; হেপাটাইটিস ' ডি' ভাইরাস ; হেপাটাইটিস ' ই ' ভাইরাস * ছোঁয়াচে (একের থেকে অন্যের ) মল মূত্র থেকে হতে পারে । সরাসরি মুখ থেকে যেমন এক গ্লাসে পানি খাওয়া বা আক্রান্ত ব্যক্তির মুখে চুমু খাওয়া; পরোক্ষভাবে আসতে পারে যেমন কাপড় চোপড় থেকে আসতে পারে । *ঘনবসতি এলাকায় যদি আক্রান্ত ব্যক্তি থাকলে তাহলে ছড়াতে পারে । * শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয় । *সহজে পানি , দুধ এবং সীল মাছ ইত্যাদি মাধ্যমে সহজে ছড়ায় । *অস্বাস্থ্যকর পরিবেশজনিত কারণে । * রক্ত দেওয়া ও নেওয়ার মাধ্যমে । * এ্যালকোহল।হেপাটাইটিস প্রথম আক্রান্তের সময়:হেপাটাইটিসের বড় শিকার সেনাবাহিনীর সদস্যেরা। ১৮৬১ সালে আমেরিকার গৃহযুদ্ধে হেপাটাইটিসে আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৫২ হাজার এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হেপাটাইটিসের বলি হন এক কোটি ষাট লক্ষ মানুষ।দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত হেপাটাইটিসের কারণ বিজ্ঞানের কাছে ছিল এক প্রহেলিকা। বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে এর কারণগুলি বোঝা সম্ভব হয়। ১৯৬৩ সালে হেপাটাইটিস-বি ভাইরাস আবিষ্কার করলেন জেনেটিক বিজ্ঞানী বারুচ স্যামুয়েল ব্লুমবার্গ। তিনি বিভিন্ন অসুখের জিনগত সংবেদনশীলতা পরীক্ষা করছিলেন। কাকতালীয় ভাবে এক অস্ট্রেলীয় আদিবাসীর রক্ত পরীক্ষার সূত্রে আবিষ্কার করলেন হেপাটাইটিস-বি ভাইরাসকে। তাই নাম দিয়েছিলেন অস্ট্রেলিয়ান অ্যান্টিজেন। দু’বছর পরে মাইক্রোবায়োলজিস্ট মিলম্যান-এর সঙ্গে আবিষ্কার করলেন হেপাটাইটিস বি-এর ভ্যাকসিন। হেপাটাইটিস-এ, হেপাটাইটিস-ডি, হেপাটাইটিস-সি এবং হেপাটাইটিস-ই ভাইরাস আবিষ্কৃত হল যথাক্রমে ১৯৭০, ১৯৭৭, ১৯৮৯ এবং ১৯৯০ সালে। ব্লুমবার্গ তাঁর আবিষ্কারের জন্য ১৯৭৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান।পরিশেষে বলতে চাই,হেপাটাইটিস হলো ভাইরাসজনিত লিভারের রোগ।চিকিৎসাবিজ্ঞানে পাঁচ ধরনের হেপাটাইটিস রয়েছে। হেপাটাইটিস এ এবং ই স্বল্পমেয়াদি লিভার রোগ। এটি বিশ্রাম নিলে এক পর্যায়ে সেরে ওঠে। তবে প্রাণঘাতী হচ্ছে হেপাটাইটিস বি এবং ছি ভাইরাসের সংক্রমণ। হেপাটাইটিসের যে পাঁচ রকম ভাইরাস আছে, তার সবগুলোর সংক্রমণই বাংলাদেশে আছে।ই ভাইরাসেই সবচেয়ে বেশি মানুষ ভোগে। এটা ছড়ায় বেশি। ই ভাইরাস মূলত পানির মাধ্যমে ছড়ায়। হেপাটাইটিস এ এবং ই ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে আক্রান্তদের ৩ শতাংশের মৃত্যু পর্যন্ত হয়। আর হেপাটাইটিস বি ও ছি ভাইরাস ছড়ায় মূলত রক্ত এবং মানবদেহের তরল পদার্থের মাধ্যমে।আর জনসচেতনতা তৈরির কোনো বিকল্প নেই। এখন মৃত্যুর এই মিছিল কমিয়ে আনতে হলে সবার আগে মানুষকে সচেতন করতে হবে।তাই হেপাটাইটিস রোগীদেরকে মনে রাখতে হবে, হেপাটাইটিস কোন সাধারণ রোগ না, তাই সঠিক চিকিৎসা পাইতে হইলে অভিজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।প্রতিবছর বিশ্বের ১৬০টি দেশের সঙ্গে বাংলাদেশে ও বিশ্ব হেপাটাইটিস দিবস পালিত হয়।