হেরোইনের যাদুর ছোঁয়ায় কোটিপতি দিনমজুর মিজান
চাঁপাইনবাবগঞ্জ প্রতিনিধি: চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা দীর্ঘদিন ধরেই হেরোইনের স্বর্গরাজ্য। নানা কলাকৌশলে এ অঞ্চলে মাদক কারবার অব্যাহত রেখেছে কয়েকটি বিশেষ সিন্ডিকেট। পদ্মাপাড়ের সীমান্তঘেঁষা এই অঞ্চলের মাদক ব্যবসায়ীরা অল্প সময়ের ব্যবধানে হয়েছেন কোটিপতি। এক সময়ের দিনমজুর, জেলে, দোকানদার, রাজমিস্ত্রী এখন বিপুল বিত্তবৈভবের মালিক। কেউ কেউ গ্রেপ্তার হলেও মাদক ব্যবসা রয়েছে আগের মতোই।এমনই এক রাজমিস্ত্রীর সহকারী (লেবার) মিজানুর রহমান মিজান হেরোইনের যাদুর ছোঁয়ায় হয়েছেন কোটিপতি। বাবা এখনও জমিতে কৃষিকাজ ও নদীতে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করলেও হেরোইন কারবারে এখন আলিসান জীবনযাপন করেন মিজান। ৫-৬ বছর আগেও ঢাকায় রাজমিস্ত্রীর সহকারী হিসেবে যোগাড়ের কাজ করলেও আলাদিনের চেরাগ হেরোইন ব্যবসায় ফুলে ফেঁপে উঠেছে তার সম্পত্তির পরিমাণ। ৪ বছর আগে বাবার সাথে জমিতে কৃষি কাজে সহযোগিতা করতে দেখা গেলেও এখন কোটি টাকার সম্পদের মালিক মিজান।চরবাগডাঙ্গার স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জের চরবাগডাঙ্গায় মাদক ব্যবসার অভিযোগ বেশ পুরোনো। তবে সম্প্রতি উত্থান ঘটেছে মিজানের মতো আরও কয়েকজন ব্যবসায়ীর। গাড়ি-বাড়ির মালিক এসব মাদক ব্যবসায়ীর কেউ কেউ ৮ অথবা ৯ বছর আগে ছিলেন মোটর শ্রমিক, ডিম বিক্রেতা, দিনমজুর কিংবা দোকান কর্মচারী। পুলিশের তালিকাভুক্ত মাদক ব্যবসায়ীদের কেউ ফেরারি, আবার কেউবা কারাগারে। অনেকেই ঘুরছে প্রকাশ্যে। স্থানীয় পুলিশ ও বিভিন্ন সংস্থায় ‘মাসোহারা’ দিয়ে তারা কারবার চালিয়ে যাচ্ছেন বলে রয়েছে অভিযোগ।চাঁপাইনবাবগঞ্জে সদর উপজেলার চরবাগডাঙ্গা চাকপাড়া গ্রামের কৃষক রফিকুল ইসলামের ছেলে মিজানুর রহমান মিজান (৩৫) চরবাগডাঙ্গা বাজারে কয়েক বছর আগেও বাবার মুদি দোকানে সহযোগিতা করতো৷ কিন্তু এখন সে কয়েক কোটি টাকার মালিক। রয়েছে চারতলা আলিশান বাড়ি, মাইক্রোবাস, রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরের দামি প্লট ও অন্তত ২০ বিঘা জমি। হেরোইনের চোরাচালান করেই তিনি কোটিপতি বলে স্থানীয়রা জানায়।অনুসন্ধান জানা যায়, গত ১০ বছর ধরে হেরোইন চোরাচালানের সাথে জড়িত রয়েছে মিজান। তবে শুরুর দিকের কয়েক বছর দেশের এক শীর্ষ মাদক ব্যবসায়ীর বহনকারী হিসেবে কাজ করেছে সে। পরবর্তীতে নিজেই সীমান্ত এলাকা থেকে মাদক সংগ্রহ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-রাজশাহীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার শুরু করে। বর্তমানে তার ৭-৮ জন বহনকারীসহ শক্তিশালী একটি চক্র একাজে নিয়োজিত রয়েছে।২ বছর আগেও ২০২২ সালের নভেম্বরে ১০ লাখ টাকা মূল্যের ১০০ হেরোইনসহ মিজানকে আটক করে জেলা পুলিশের গোয়েন্দা শাখা-ডিবি পুলিশ। এই মামলাটি বর্তমানে আদালতে চলমান রয়েছে। জামিনে মুক্ত থাকলেও যেকোনো সময় হতে পারে মামলার রায়। এদিকে, তার মাদক সিন্ডিকেটে সরাসরি যুক্ত রয়েছেন পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দুই জন কর্মকর্তা। তাদের মদদেই হেরোইনের কারবারে ফুলে ফেঁপে উঠেছে মিজানের সম্পদ। সম্প্রতি তাকে মদদদাতা এক পুলিশ কর্মকর্তার বদলি হয়েছে ঢাকায়। অন্যদিকে, মিজানের দেয়া তথ্যে প্রতিযোগী হেরোইন কারবারিদের আটক করলেও তাকে রেহাই দেন মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। পুলিশ ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের দুই কর্মকর্তার যোগসাজশ নিয়ে বিস্তারিত থাকবে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে।তবে আপাতত শুধু হেরোইন নয়, এর পাশাপাশি আরও কয়েকটি ব্যবসায় মনোযোগ দিয়েছেন মিজানুর রহমান মিজান। হেরোইন টাকায় জেলা শহরের বিশ্বরোড এলাকায় এমজে ট্রেডার্স নামের একটি এসএস পাইপ ও স্টিলের ওয়ার্কশপ দিয়েছেন। তিন বছরের মধ্যেই বিশ্বরোড মোড় এলাকায় চারতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। মহাডাঙ্গা ও এর আশেপাশে কয়েকটি পুকুর, বারোঘরিয়ায় মাটির প্লট কিনেছেন মিজান। রয়েছে কয়েকটি মাইক্রো ও ট্রাক। বিভিন্ন জায়গায় প্লটের কারবার শুরু করেছেন মিজান।নাম প্রকাশ না করার শর্তে তার কয়েকজন আত্মীয় ও প্রতিবেশী জানায়, তার বাবা রফিকুল ইসলামের আড়াই বিঘা ও ভিটেমাটি রয়েছে। বাবার বাড়ি এখনও অর্ধেক জায়গায় টিনের তৈরি। তার বাবা রফিকুল ইসলাম দীর্ঘদিন মুদি দোকান ও লবণের ব্যবসা করেছেন। অথচ চরবাগডাঙ্গা বাজারে থাকা একটি মোবাইল ব্যাংকিং শাখার ডিলারসীপ নিয়েছেন মিজান। এমনকি সেখানে সকল বিনিয়োগও তার।জানা যায়, মিজানের হেরোইন বহন করতে গিয়ে ২০২১ সালে রাজশাহীতে ৯০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক হয় খাইরুল ইসলাম নামের এক ব্যক্তি। একই বছর রাজশাহীর কাশিয়াডাঙ্গায় প্রায় ২ কোটি টাকা মূল্যের ১ কেজি ৮০০ গ্রাম হেরোইনসহ আটক হয় মিজানের আরেক বহনকারী।তবে এ বিষয়ে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করলেও কথা বলতে রাজি হননি মাদক সম্রাট মিজানুর রহমান মিজান। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু অসাধু কর্মকর্তার সাথে তার যোগসাজশের বিভিন্ন তথ্য প্রমাণ নিয়ে বিস্তারিত থাকবে ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্বে।