পূর্বধলায় টিআর-কাবিখা প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ
নেত্রকোণা প্রতিনিধি: নেত্রকোণার পূর্বধলা উপজেলায় ২০২২-২০২৩ ও ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টি আর), গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিখা/কাবিটা) প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে।প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা উত্তোলন, কাজ শেষে বিল না পাওয়াসহ প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগে জেলা প্রশাসক এবং জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগ করেছেন স্থানীয় তাজুল ইসলাম ও সজিব তালুকদার।২১ আগস্ট উপজেলার কাজলা গ্রামের কামাল উদ্দিন তালুকদারের পুত্র মো. সজিব তালুকদার জেলা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ কর্মকর্তা বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় ১৫টি প্রকল্পের অনুকূলে ১৯ লক্ষ ৪০ হাজার ৮২৫ টাকা বরাদ্দের কোন কাজ হয়নি।অন্যদিকে ৩ অক্টোবর পূর্বধলা উপজেলার কাজলা গ্রামের গিয়াস উদ্দিন তালুকদারের পুত্র রফিক উদ্দিন ও জালাল উদ্দিন তালুকদারের পুত্র তাজুল ইসলাম জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করেন- ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিকা-কাবিটা) প্রকল্পের আওতায় ২টি প্রকল্পের সভাপতি, সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করেও এখন পর্যন্ত টাকা পাননি।সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় পশ্চিম কাজলা পাকা রাস্তা হতে আহমদের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত উন্নয়ন প্রকল্পে ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।আহমদের ছোট ভাই ইদ্রিস মিয়া জানান, বিগত ৫ বছরে এই রাস্তায় সরকারি অনুদানে এক টাকার কাজও হয়নি। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় কাজলা মাইন উদ্দিন তালুকদারের সামাজিক কবরস্থান মেরামত/উন্নয়ন প্রকল্পে ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।মৃত আলাউদ্দিন তালুকদারের পুত্র কামাল উদ্দিন তালুকদার দাবী করে বলেন, এটা তাদের পারিবারিক কবরস্থান। বিগত ৫ বছরেও সরকারি অনুদানের টাকায় এই কবরস্থানের কোন উন্নয়ন কাজ হয়নি। একই অর্থ বছরে বীর বৈরাটি জইন উদ্দিনের সামাজিক কবরস্থান মেরামত/উন্নয়ন প্রকল্পে ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। বীর বৈরাটি জইন উদ্দিনের সামাজিক কবরস্থানটি ২০১৯-২০২০ অর্থ বছরে নেত্রকোণা জেলা পরিষদ হতে ৩ লক্ষ টাকা বরাদ্দে উন্নয়ন করা হয়েছে বলে কবরস্থানের প্রাচীরে নাম ফলকে দেখা যায়।জইন উদ্দিনের ভাতিজা সাহেদুজ্জামান জানান, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) প্রকল্পের টাকায় কবরস্থানের কোন উন্নয়ন হয়নি। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় কাজলা মড়ল বাড়ি হতে আবু তাহেরের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত/উন্নয়ন প্রকল্পে ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।আবু তাহেরের ছোট ভাই আব্দুর রাশিদ জানান, তাদের বাড়িই মড়ল বাড়ি হিসাবে পরিচিত এবং তার বড় ভাই আবু তাহের এই বাড়িতেই থাকেন। বিগত ৪ বছর আগে এই রাস্তার উন্নয়নে মাটি কাটা হয়েছিল। তারপর রাস্তায় আর কোন মাটি দেওয়া হয়নি। একই অর্থ বছরে কাজলা বিপ্লবের বাড়ি হতে পোস্ট অফিস পর্যন্ত রাস্তা মেরামত উন্নয়ন প্রকল্পে ৯০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।কাজলা গ্রামের মৃত আব্দুল হামিদের পুত্র আইন উদ্দিন ও সায়েন উদ্দিনের পুত্র রিয়াজ মন্ডল বলেন, বিগত ৪ বছর আগে এই রাস্তায় মাটি কাটা হয়েছিল। তারপর আর কোন কাজ হয়নি। ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) প্রকল্পের আওতায় কাজলা জামিরের বাড়ি হতে মহিমা পাকা রাস্তা পর্যন্ত রাস্তা পুন:নির্মাণ প্রকল্পে ৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।হযরত আলীর পুত্র ফারুক মিয়া জানান, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় এই প্রকল্পে যার কোনটাই কাজ হয়নি। ২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিকা-কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় বীর বৈরাটি আব্দুল কুদ্দস সাহেবের বাড়ি হতে দরুন বৈরাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা পুন:নির্মাণ প্রকল্পে ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।বীর বৈরাটি আব্দুল কুদ্দস সাহেবের পুত্র ওয়াহেদুজ্জামান ও রুকনুজ্জামান জানান, বীর বৈরাটি আব্দুল কুদ্দস সাহেবের বাড়ি হতে দরুন বৈরাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রায় ২ কিলোমিটার রাস্তা। এর মধ্যে ১ কিলোমিটার পাকা রাস্তা এবং ১ কিলোমিটার মাটির রাস্তা। চলতি অর্থ বছরে এই রাস্তায় প্রায় ৫০০ মিটার জায়গায় ভেকু দিয়ে সামান্য করে মাটি দিয়েছে।বাহার উদ্দিন ও সজিব মিয়া জানান, ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে এই একই রাস্তায় দুইটি টিআর প্রকল্পের মাধ্যমে ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা এবং একটি কাবিটা প্রকল্পের মাধ্যমে ৪ লক্ষ ১০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এই রাস্তায় ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে ৩টি প্রকল্পের মাধ্যমে ৫ লক্ষ ৮০ হাজার টাকার বরাদ্দ দেওয়া হলেও কোন বরাদ্দই সরেজমিনে বাস্তবায়ন হয়নি। প্রকল্প বাস্তবায়ন শুধু কাগজে কলমে। চলতি অর্থ বছরে বীর বৈরাটি আব্দুল কুদ্দস সাহেবের বাড়ি হতে দরুন বৈরাটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত প্রকল্পের অর্ধেক রাস্তা পাকা রাস্তার উপর মাটির রাস্তা নির্মাণে ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও ৫০ হাজার টাকার প্রকল্পও বাস্তবায়ন করা হয়নি।২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর) কর্মসূচির আওতায় কাজলা কান্দাপাড়া বায়তুল মামুর জামে মসজিদ উন্নয়ন প্রকল্পে ৫০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও কাজলা গ্রামে কান্দাপাড়া বায়তুল মামুর জামে মসজিদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।২০২৩-২০২৪ অর্থ বছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিকা-কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় সাহেদা স্মৃতি পাঠাগার হতে কাজলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত রাস্তা পুন:নির্মাণ প্রকল্পে ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয় এবং কাজলা জামতলা বাজার হতে কান্দুলিয় রুহুল আমিনের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা পুন:নির্মাণে ৫ লক্ষ টাকা বরাদ্দ হয়। প্রকল্প দু’টিতে আংশিক কাজ হলেও প্রকল্পের সভাপতি তাজুল ইসলাম ও রফিক উদ্দিন জাহাঙ্গীর প্রকল্পের অর্থ না পাওয়ায় জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ করেছেন।প্রকল্পের সভাপতি তাজুল ইসলাম ও রফিক উদ্দিন জাহাঙ্গীর বলেন, তাদের স্বাক্ষর পরিবর্তন করে জালিয়াতির মাধ্যমে প্রকল্পের অর্থ উত্তোলন করে আত্মসাৎ করা হয়েছে। জালিয়াতি চক্রটি সনাক্ত করে আইনের আওতায় আনার দাবী করেন।পূর্বধলা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এসব অভিযোগ মিথ্যা, বানোয়াট ও উদ্দেশ্য প্রণোদিত। আমার কাছ থেকে টাকা আদায়ের জন্যই এসব অভিযোগ। প্রকল্পগুলো আমি নিজে তদারকি করেছি। প্রকল্পগুলোতে সঠিকভাবেই কাজ হয়েছে।জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা মুহাম্মদ রুহুল আমীন বলেন, এ বিষয়ে জেলা প্রশাসক উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দাখিলের জন্য বলেছেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এখনো প্রতিবেদন দাখিল করেননি। অনিয়ম প্রকল্প কর্মকর্তা জড়িত থাকলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবেন বলে তিনি জানান।পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মো. খবিরুল আহসান বলেন, জেলা প্রশাসকের পক্ষ থেকে বৈরাটি ইউনিয়নে প্রকল্পের কাজে অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ পেয়েছি। তদন্ত চলমান আছে। তদন্তে অনিয়ম প্রমাণিত হলে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।জেলা প্রশাসক বনানী বিশ্বাস বলেন, অভিযোগটি তদন্তের জন্য পূর্বধলা উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) কে বলা হয়েছে।