তাজরীন ট্রাজেডির ১১ বছরেও দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেনি বেঁচে ফেরা শ্রমিকরা
স্টাফ রিপোর্টার, সাভার: সাভারের তাজরীন ট্রাজেডি অগ্নিকাণ্ডের ১১ বছর অতিবাহিত হচ্ছে আজ। ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে কারখানাটির ১১৭ জন শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা যান। আর আহত হন ২০০ শ্রমিক। সেই দুঃসহ স্মৃতি ভুলতে পারেনি অগ্নিকাণ্ডে হতাহত শ্রমিক ও তাদের পরিবার। এখনো তাদের অনেকে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। দেশের ইতিহাসে শতাধিক শ্রমিক অগ্নিদগ্ধ হয়ে মৃত্যুর ট্রাজেডি এটাই প্রথম।২৪ নভেম্বর, এই দিন মনে করিয়ে দেয় নিহতদের পরিবারের সদস্যদের স্বজন হারানোর বেদনা। কেউ হারিয়েছে মাকে, বোনকে, বাবাকে কেউ বা আবার হারিয়েছেন পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিকে। তাই তো স্বজনহারা মানুষরা আজো ডুকরে কেঁদে উঠেন । উপার্জনক্ষম মানুষগুলোই এখন তাদের পরিবারের বোঝা, কেউবা কোনোমতে দোকান দিয়ে চালিয়ে যাচ্ছে তাদের জীবন যুদ্ধ। কেউবা চিকিৎসা করাতেই নামমাত্র ক্ষতিপূরণসহ শেষ করেছেন তাদের সর্বস্ব। আবার অনেকেই বঞ্চিত হয়েছেন ক্ষতিপূরণ থেকেও। তারা আজ ১১ বছর ধরে অপেক্ষায় আছেন ক্ষতিপূরণের আশায় আর প্রহর গুনছেন পুনর্বাসনের।আহত শ্রমিকরা সরকারসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকে সাময়িক কিছু সহায়তা পেলেও পূর্ণাঙ্গ ক্ষতিপূরণ ও পুনর্বাসন পাননি। বহু পরিবার তাদের উপার্জনক্ষম মানুষ হারিয়ে ঘোর বিপদে পড়েছে।তাজরীনে অগ্নিকাণ্ডের ১১ বছরে নিহত শ্রমিকদের স্বজন, আহত ব্যক্তি, বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীরা কারখানার ফটকের সামনে আজ ২৪ নভেম্বর সারাদিন ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাচ্ছেন।রেবা খাতুন ২০১২ সালে তাজরীন ফ্যাশনের তিন তলায় সুইং অপেরটর হিসেবে কাজ করতেন। তিনিও সেদিন আগুন লাগার কিছুক্ষণ পর তিন তলা থেকে লাফ দেন। সেই লাফ দিয়ে নিচে নামায় তার কোমরে হাড় ও পায়ে ব্যথা পান। সেই ব্যথা নিয়ে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে নেতাসহ সংশ্লিষ্ট সকল দফতরে ক্ষতিপূরণ ও মালিকের বিচারের দাবি করে আসছেন। কিন্তু কোনো দাবি এখনো তাদের পূর্ণ হয়নি।তিনি বলেন, এই ১১টা বছর কতো না জায়গায় গিয়েছি। শুধু বিদেশি কিছু সহায়তা ছাড়া আর কিছুই পায়নি। এখন যদি কোথাও আমাদের দাবি জানাতে যাই, তাহলে নানা মহল থেকে চাপ আসে। এ যাবৎ লাখ খানেক টাকা সহায়তা পেয়েছি তবে সেটা ক্ষতিপূরণ না। আমরা মালিকের বিচার চাই, আমাদের ক্ষতিপূরণ চাই। আহত ও নিহত শ্রমিকদের স্বজনদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন শিল্পী রানী। তিনিও তাজরীন গার্মেন্টসের আগুনে পুড়ে যাওয়া ভুক্তভোগী একজন শ্রমিক। তিনি বলেন, আমরা কার কাছে যাবো, কী বলবো? মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলতে পারি না। কথা বলতে গেলে পরে খুঁজে বের করে নানা চাপ দেয়। এ যাবৎ কাল অনেক বলেছি, কিন্তু কোনো প্রতিকার পাইনি। আজ এতোগুলো শ্রমিক মানবেতর জীবন যাপন করছেন। আমাদের খোঁজ কে রাখে। আমাদের কোনো দাবি এখনো পূর্ণ হয়নি। সরকার তো পারে আমাদের তাজরীনের ভবনটি আমাদের জন্য কাজে লাগাতে, কিছু শ্রমিক হলেও তো সেখানে থাকতে পারবো। এ ব্যাপারে গার্মেন্টস শ্রমিক ঐক্য লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. সারোয়ার হোসেন বলেন, তাজরীন ট্রাজেডির আজ ১১ বছর অতিবাহিত হলেও এখন পর্যন্ত তাজরীনের ভবন দানবের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। এই অগ্নিকাণ্ডে যেসকল শ্রমিক নিহত ও আহত হয়েছিলো সকল শ্রমিক এবং তাদের পরিবারকে এই ভবনে নতুন কোনো কারখানা অথবা হাসপাতাল বানিয়ে তাদেরকে পুনর্বাসন করে কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জোর দাবি জানাচ্ছি।এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোশাক শ্রমিক ট্রেড ইউনিয়ন ফেডারেশনের সভাপতি তুহিন চৌধুরী বলেন, তাজরীনে আগুন লাগার পর কারখানা কর্তৃপক্ষ গেটে তালা লাগিয়ে কারখানার মালিক দেলোয়ার হোসেনের সুপরিকল্পিতভাবে ১১৭ জন শ্রমিককে হত্যা করেছে এবং আহত হয়েছে শতশত শ্রমিক। এ ঘটনার ১১ বছর পার হলেও দোষীদের শাস্তি নিশ্চিত করা হয়নি। বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে মালিকপক্ষের অবহেলায় পোশাকশিল্পে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। অতিবিলম্বে তাজরীনের ক্ষতিগ্রস্ত শ্রমিকদের পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করার দাবি জানান তিনি।