ভুয়া ভাউচারে মাদরাসা সুপারের পকেটে লাখ লাখ টাকা
নওগাঁ প্রতিনিধি: নওগাঁয় পারফরমেন্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশনস (পিবিজিএসআই) স্কিমের আওতায় ব্যবস্থাপনা জবাবদিহি অনুদানের ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬৯ টাকা হরিলুটের অভিযোগ উঠেছে মাতাসাগর ইয়ার উদ্দিন ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা নামে এক প্রতিষ্ঠানের প্রধারের বিরুদ্ধে।নামে জবাবদিহি অনুদান হলেও ভুয়া ভাউচার দাখিলের মাধ্যমে কোনো রকম জবাবদিহিতা ছাড়াই এ টাকা হরিলুট করেছেন প্রতিষ্ঠানটির সুপার মুহাম্মদ মামুনুর রশিদ। দুর্নীতির এ টাকাকে বৈধতা দিতে আয়কর ও ভ্যাট দিতেও দেখা গেছে সুপারকে।প্রতিষ্ঠানটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি পদে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ছলিম উদ্দিন দেওয়ান থাকায় আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে এ দুর্নীতির বিরুদ্ধে কেউ কথা বলতে পারেননি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর মাদরাসা সুপার ও সভাপতির যোগসাজসে হওয়া পিবিজিএসআই স্কিমের অর্থ হরিলুটের বিষয়ে মুখ খুলতে শুরু করেছেন প্রতিষ্ঠানটির বর্তমান ও সাবেক শিক্ষকরা। কিন্তু দুর্নীতির তথ্য জেনেও দায়সারা ভূমিকায় লিখিত অভিযোগ পাওয়ার প্রহর গুণছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, পারফরমেন্স বেজড গ্র্যান্টস ফর সেকেন্ডারি ইনস্টিটিউশনস (পিবিজিএসআই) স্কিমের আওতায় ২০২২-২৩ অর্থবছরে দ্বিতীয় পর্যায়ে সারাদেশের স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা ক্যাটাগরির ২ হাজার ৫০০টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ৫ লাখ টাকা করে ব্যবস্থাপনা জবাবদিহি অনুদান দেয় মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। এই স্কিমের আওতায় নওগাঁ সদর উপজেলার মাতাসাগর ইয়ার উদ্দিন ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার ব্যাংক হিসাব নম্বরে ৫ লাখ টাকা বরাদ্দ আসে। বরাদ্দকৃত এই অর্থের ২০ শতাংশ বা ১ লাখ টাকা শিক্ষকদের প্রণোদনায়, ১৫ শতাংশ বা ৭৫ হাজার টাকা সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের সহায়তায় এবং ১০ শতাংশ বা ৫০ হাজার টাকা প্রতিবন্ধী বা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীদের ফ্যাসিলিটি উন্নয়নে খরচ করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। বাকি ৩০ শতাংশ বা ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা দিয়ে বইপত্র, লাইব্রেরি, শিক্ষা উপকরণ এবং গবেষণা সরঞ্জাম কেনা এবং ২৫ শতাংশ বা ১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ছাত্র-ছাত্রী বিশেষ করে ছাত্রীদের জন্য অবকাঠামো, বিশুদ্ধ পানি, শৌচাগার, কমনরুম উন্নয়নে ব্যয় করার নির্দেশনা রয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের (মাউশি)।বরাদ্দকৃত এ অর্থ খরচের বিপরীতে নওগাঁ শহরের মুক্তির মোড় এলাকার অন্তর ফার্নিচার হাউজের ২টি ভাউচারে মোট ১ লাখ টাকা, রেজিস্ট্রি অফিস মোড় এলাকার মেসার্স বই ঘরের ২টি ভাউচারে মোট ৫০ হাজার টাকা, মহাদেবপুর উপজেলার পাহাড়পুর এলাকার ওয়াসিউ আইটির ভাউচারে ৫০ হাজার টাকা, মান্দা উপজেলার প্রসাদপুর বাজার এলাকার মেসার্স রমা ট্রেডার্সের ২টি ভাউচারে ৯৯ হাজার ৪০০ টাকা, মান্দা উপজেলার সতিহাট এলাকার মেসার্স সৈয়দপুর ব্রিক্স ফিল্ডের ১টি ভাউচারে ২৫ হাজার ৬০০ টাকা, ১৫ জন শিক্ষার্থীকে সহায়তা বাবদ ২টি ভাউচারে মোট ৭৫ হাজার টাকা, ১৩ জন শিক্ষকের মাঝে প্রণোদনা বাবদ ২টি ভাউচারে ১ লাখ টাকা প্রদানের প্রমাণপত্র সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাখিল করেছেন মাদরাসা সুপার মুহাম্মদ মামুনুর রশিদ। এ হিসাবে মামুনুর রশিদের মোট খরচ ৫ লাখ টাকা। এই ৫ লাখ টাকার মাঝে আয়কর ও ভ্যাট সমন্বয়ক করা হয়েছে ৪৪ হাজার ১৩১ টাকা। যার স্বপক্ষে কর অঞ্চল রাজশাহী বরাবর ২টি ভাউচারে ১৯ হাজার ৭৫৫ টাকা এবং শুল্ক, আবগারী ও ভ্যাট কমিশনারেট কার্যালয় নওগাঁ বিভাগীয় কার্যালয় বরাবর একটি ভাউচারে ২৪ হাজার ৩৭৬ টাকা প্রদানের প্রমাণপত্র সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ে দাখিল করেছেন মাদরাসা সুপার।তবে তথ্যানুসন্ধানে দেখা গেছে ভিন্ন চিত্র। দাখিল করা এসব ভাউচারের মধ্যে অন্তর ফার্নিচার হাউজ থেকে ১ লাখ টাকা মূল্যে কোনো ধরনের আসবাবপত্র নেয়নি মাতাসাগর ইয়ার উদ্দিন ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা। এছাড়া ওয়াসিউ আইটি থেকে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের ল্যাপটপ, রমা ট্রেডার্স থেকে ৯৯ হাজার ৪০০ টাকার স্যাটিটেশন ও নির্মাণ সামগ্রী, সৈয়দপুর ব্রিক্স ফিল্ড থেকে ২৫ হাজার ৬০০ টাকা মূল্যের ইট এবং বই ঘর থেকে ৫০ হাজার টাকা মূল্যের বইসহ কোনো পণ্যই নেয়নি ওই মাদরাসা। শিক্ষার্থীদের সহায়তা বাবদ ৭৫ হাজার টাকা বিতরণের ভাউচারটিও ভুয়া। ওই ভাউচারে সহায়তাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগে ব্যবহৃত মুঠোফোন নম্বরের তালিকায় শিক্ষকদের নম্বর সুকৌশলে ব্যবহার করা হয়েছে। যাতে কেউ চাইলেও সহায়তাপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে না পারেন।সবকটি ভুয়া ভাউচারে একই ব্যক্তির হাতের লেখা ব্যবহার করা হয়েছে। সেই হিসাবে আয়কর ও ভ্যাট বৈধভাবে প্রদানের পরও পিবিজিএসআই স্কিম থেকে ভুয়া ভাউচারের মাধ্যমেই ৩ লাখ ৬৫ হাজার ৮৬৯ টাকা হরিলুট করেছেন মাদরাসা সুপার ও সভাপতি।ওয়াসিউ আইটির পরিচালক মামুন হোসেন বলেন, মাতাসাগর ইয়ার উদ্দিন ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সুপার আমার পরিচিত নন। ৫০ হাজার টাকা মূল্যের কোনো ল্যাপটপ তারা আমাদের থেকে নেননি। ভাউচারটি সম্পূর্ণ ভুয়া ও অসত্য। এটি নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জ করে বলতে পারি। তাদের সঙ্গে কোনো ধরনের লেনদেন আমাদের হয়নি।মেসার্স রমা ট্রেডার্সের ম্যানেজার মিলন কুমার মন্ডল বলেন, ৪৯ হাজার ৯০০ টাকা এবং ৪৯ হাজার ৫০০ টাকার যে ভাউচার মাতাসাগর ইয়ার উদ্দিন ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা ব্যবহার করেছে সেটি ভুয়া। খালি ভাউচার সংগ্রহ করে তারা এটি নিজ হাতে লিখে নিয়েছে। ওই প্রতিষ্ঠানে সিমেন্ট, টাইলস, প্লাস্টিকের দরজা, টিউবওয়েল, সাবমারসিবল পাম্প এবং ফিটিংস সামগ্রীর কিছুই তারা দেননি। ওই হাতের লেখা আমাদের কারোর নয়।ভাউচার অনুযায়ী তৎকালীন সময়ে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ুয়া সুমাইয়া বানু ও নবম শ্রেণি পড়ুয়া শিরিনা আক্তার ৫ হাজার টাকা করে মোট ১০ হাজার টাকা অনুদান পেয়েছেন। সুমাইয়া ও শিরিনা আদৌ সেই টাকা পেয়েছেন কি না জানতে তাদের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরের ঘরে উল্লেখ করা নম্বরে কল করা হলে রিসিভ করেন প্রতিষ্ঠানটির সাবেক সহকারী শিক্ষক মিজানুর রহমান। ভাউচারটি যাচাইকারী হিসেবেও সেখানে স্বাক্ষর রয়েছে মিজানুর রহমানের। তবে এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বাক্ষরটি নিজের নয় বলে দাবি করেন তিনি।মিজানুর রহমান জানান, কেউ আমার স্বাক্ষর জাল করে এই ভাউচার দাখিল করেছে। আমি বর্তমানে মহাদেবপুর উপজেলার জোয়ানপুর ইবতেদায়ী ফাজিল মাদরাসায় প্রভাষক হিসেবে কর্মরত আছি। ওই প্রতিষ্ঠানে থাকাকালীন যে হাজিরা খাতা ছিল সেখানকার স্বাক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে দেখলেই প্রমাণ হবে স্বাক্ষরটি জাল।দুলা বানু নামে অষ্টম শ্রেণি পড়ুয়া আরেক শিক্ষার্থীর ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নম্বরের ঘরে উল্লেখিত নম্বরে কল করা হলে একইভাবে রিসিভ করেন মাতাসাগর ইয়ার উদ্দিন ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সহকারী শিক্ষক রেবেকা সুলতানা।জানতে চাইলে তিনি বলেন, কমিটির টিআর সদস্য হওয়া সত্ত্বেও পিবিজিএসআই স্কিমের টাকা কোন খাতে কিভাবে খরচ হয়েছিল সেটি আজও আমাকে জানানো হয়নি। অনেক কিছু না দেখেই রেজুলেশন খাতায় স্বাক্ষর করতে হয়। শিক্ষকদের প্রণোদনার ১ লাখ টাকা ছাড়া বাকি ৪ লাখ টাকা খরচের হিসাব আমার জানা নেই। শিক্ষার্থীর নম্বরের জায়গায় ষড়যন্ত্রমূলকভাবে আমার নম্বর ব্যবহার করা হয়েছে।অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মাতাসাগর ইয়ার উদ্দিন ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসার সুপার মুহাম্মদ মামুনুর রশিদ বলেন, প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নের স্বার্থে ভুয়া ভাউচারগুলো দাখিল করা হয়েছিলো। সেখান থেকে পাওয়া নগদ টাকায় এখনো উন্নয়ন কাজ চলমান রেখেছি। তবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে যথাযথভাবে টাকা বুঝিয়ে দিয়েছি। অর্থ হরিলুটের পরিকল্পনা কখনোই আমার মাঝে ছিল না। সবকিছুই পর্যায়ক্রমে করা হবে।দুবলহাটি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের ৫নং ওয়ার্ডের সভাপতি ও মাতাসাগর ইয়ার উদ্দিন ইসলামিয়া দাখিল মাদরাসা পরিচালনা কমিটির সাবেক সভাপতি ছলিম উদ্দিন দেওয়ান বলেন, পিবিজিএসআই স্কিমের টাকা কোথায় কতটুকু খরচ হয়েছে, সেই হিসাব আমার জানা নেই। এটি সুপার নিজ হাতে খরচ করেছেন। কোনো দুর্নীতি হয়ে থাকলে সেটার দায়ভার সুপারের।নওগাঁ সদর উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা ওয়াসিউর রহমান বলেন, পিবিজিএসআই স্কিমের বরাদ্দ দেওয়ার পুরোটাই সরাসরি অধিদপ্তর থেকে নিয়ন্ত্রিত ছিল। প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজ নিজ ব্যাংক হিসাব নম্বরে সরাসরি টাকা দিয়ে এরপর আমাদের অফিসের মাধ্যমে রশিদগুলো জমা নিয়েছে অধিদপ্তর। যেহেতু নিজেরা তদারকি করার সময় পাইনি, স্বাভাবিকভাবেই এখানে কিছুটা অনিয়ম হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ পাইনি। অভিযোগ পেলে তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।