মোগল স্থাপত্যের ছোঁয়ায় নির্মিত ‘হিন্দা শাহী মসজিদ’
কালাই (জয়পুরহাট) প্রতিনিধি: জয়পুরহাট জেলার ক্ষেতলাল উপজেলার হিন্দা শাহী পাঁচ গম্বুজ মসজিদ ঐতিহ্য, সৌন্দর্য ও ইসলামী স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন। জেলা সদর থেকে ১৫ কিলোমিটার ও উপজেলা সদর থেকে ৬ কিলোমিটার দক্ষিণে বড়াইল ইউনিয়নের হিন্দা কসবা গ্রামের তিন মাথা বাজারে অবস্থিত এই মসজিদটি দূর-দূরান্ত থেকে সৌন্দর্যপিপাসু ও ধর্মপ্রাণ মানুষকে আকৃষ্ট করে।মসজিদটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এর দেয়াল ও বাহ্যিক সৌন্দর্য। সাধারণত মোগল আমলের মসজিদগুলোতে পোড়ামাটির নকশার ব্যবহার দেখা যায়, তবে এই মসজিদে ব্যবহৃত হয়েছে কাচ, চিনামাটির টুকরা ও মোজাইকের সমন্বয়ে তৈরি নানা কারুকাজ। সূর্যের আলো পড়লে মসজিদের ঝলমলে দৃষ্টিনন্দন রূপ সবাইকে মুগ্ধ করে।মসজিদের অভ্যন্তরীণ অংশও দৃষ্টিনন্দন। ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভের প্রতীক হিসেবে এখানে পাঁচটি গম্বুজ নির্মাণ করা হয়েছে। মাঝে বড় একটি এবং চারপাশে চারটি ছোট গম্বুজ, যা সম্পূর্ণ রড ছাড়াই নির্মিত। মসজিদের ভেতরের দৈর্ঘ্য ৪৯.৫০ ফুট ও প্রস্থ ২২.৫০ ফুট। উত্তর পাশে ৪০ ফুট উচ্চতার একটি মিনার রয়েছে, যার নিচে রয়েছে একটি ছোট কক্ষ, যেখানে আযানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। মিনারের শীর্ষে মাইকের মাধ্যমে আযানের ধ্বনি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লা জেলার মুরাদনগরের পীর কাশিমপুর গ্রামের প্রখ্যাত পীর হযরত খাজা শাহ্ মাওলানা আব্দুর গফুর চিশতীর নির্দেশে তাঁরই অন্যতম খলিফা আব্দুল খালেক চিশতি এলাকাবাসীর সহায়তায় এই মসজিদ নির্মাণ করেন। বাংলা ১৩৬৫ সালে (১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দ) এই মসজিদটির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়।স্থানীয় বাসিন্দা প্রবীণ শিক্ষক ছাবের হোসেন ফকির জানান, আমার জন্মের আগেই এই মসজিদ নির্মাণ হয়েছে। ছোটবেলায় দাদা-নানার সঙ্গে এই মসজিদে নামাজ পড়েছি, এখনও নামাজ পড়ি। শুনেছি মসজিদের সঙ্গে সংলগ্ন দুটি মাজার রয়েছে, যা প্রায় দেড় শতাধিক বছরের পুরনো।এই মসজিদের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর ছাদ নির্মাণে কোনো রড ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়া, মসজিদের অভ্যন্তরে মাঝখানের বড় গম্বুজের ভেতরে পবিত্র আয়াতুল কুরসী ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে লেখা রয়েছে, যা ধর্মপ্রাণ মুসল্লিদের মুগ্ধ করে। দেয়ালে বিভিন্ন রঙের কাচ, চিনামাটির টুকরা ও মোজাইক পাথরের মাধ্যমে সৌন্দর্য আরও বৃদ্ধি করা হয়েছে।মসজিদ সংলগ্ন পূর্ব পাশে হযরত শাহ্ সুলতান বখতির চারজন শিষ্যের মাজার রয়েছে। প্রতি বৃহস্পতিবার এখানে হালকায়ে জিকির অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে দূর-দূরান্ত থেকে ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা অংশগ্রহণ করেন।হিন্দা শাহী মসজিদের সুনাম দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। সিরাজগঞ্জ থেকে আসা আমিনুর রহমান নামে এক ব্যক্তি বলেন, রাজশাহী বিভাগের মধ্যে এই মসজিদের গুণের কথা শুনে এসেছি। জুমার নামাজ আদায় করে খুব ভালো লেগেছে। ইমামের পিছনে নামাজ আদায় করার অনুভূতি ছিল অসাধারণ। নামাজ শেষে মহান আল্লাহর কাছে সবার জন্য দোয়া করেছি।”যদিও মসজিদটি তার সৌন্দর্য ও স্থাপত্যশৈলীর জন্য প্রসিদ্ধ তবে যথাযথ সংরক্ষণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগের মাধ্যমে এর রক্ষণাবেক্ষণ করা হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এই ঐতিহ্যবাহী স্থাপনার সৌন্দর্য উপভোগ করতে পারবে।মসজিদের খতিব মাওলানা আব্দুস সালাম জানান, আমি তিন বছর ধরে এই মসজিদের খতিবের দায়িত্ব পালণ করছি। যতটা শুনেছি, এই এলাকা ছিল একেবারে অন্ধকার। পীর কাসিমপুরের চিশতিয়া তরিকার অন্যতম পীর হযরত আব্দুল গফুর চিশতীর (রহ.) নির্দেশে এখানে এই মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। ঐতিহ্যবাহী এই মসজিদ দেখার জন্য দূর-দূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। এখানে দেশী-বিদেশী অনেক মুসল্লিরা নামাজ আদায় করতে আসেন।তিনি আরও বলেন, জয়পুরহাটের হিন্দা শাহী মসজিদ শুধু একটি ধর্মীয় উপাসনালয় নয়, এটি ঐতিহাসিক স্থাপত্যের এক অনন্য নিদর্শন। মোগল স্থাপত্যশৈলীর অপূর্ব মিশ্রণে নির্মিত এই মসজিদ যুগ যুগ ধরে ইসলামী সংস্কৃতি ও স্থাপত্যের ধারক ও বাহক হিসেবে টিকে থাকবে।