বাস্তুভিটায় মীর মশাররফ হোসেনের ১৭৭তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন
কুমারখালী (কুষ্টিয়া) প্রতিনিধি: উনিশ শতকের আলোকিত গদ্যশিল্প বাংলা সাহিত্যের অন্যতম কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার ও প্রাবন্ধিক মীর মশাররফ হোসেনের ১৭৭তম জন্মবার্ষিকী উদযাপন করা হয়েছে। কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার লাহিনীপাড়ার তাঁর বাস্তুভিটায় সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসন দুই দিনব্যাপী নানা অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে।১৩ নভেম্বর বুধবার বেলা তিনটায় প্রতিবারের ন্যায় এবারও গ্রামীণ ঐতিহ্য লাঠিখেলার মধ্য দিয়ে অমর এই কথা সাহিত্যিকের জন্মবার্ষিকীর অনুষ্ঠানমালার কার্যক্রম শুরু হয়। বিকাল ৪টায় উপজেলা নির্বাহী অফিসার এস এম মিকাইল ইসলামের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয় সাহিত্যকর্মের উপর আলোচনা সভা। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন জেলা প্রশাসক মো. তৌফিকুর রহমান।সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মো. আমিরুল আরাফাতের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠিত আলোচনা সভায় বিশেষ অতিথি ছিলেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোছা. শারমিন আক্তার ও কুষ্টিয়া প্রেসক্লাবের সভাপতি আল মামুন সাগর। আলোচক হিসেবে অমর সাহিত্যিকের সাহিত্যকর্মের উপর বিস্তারিত আলোচনা করেন ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. রশিদুজ্জামান।আলোচনা সভা শেষে কুমারখালী উপজেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমির পরিবেশনায় অনুষ্ঠিত হয় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। রাতে অনুষ্ঠিত হয় গাজি মিয়ার বস্তানি ও উদাসীন পথিকের মনের কথা অবলম্বনে "কারো কিছু বলার নেই " নাটক মঞ্চায়ন করে লাহিনীপাড়া বিজয় নাট্যগোষ্ঠী।বৃহস্পতিবার বিকাল ৪টায় সমাপনী ও আলোচনা সভা শেষে জেলা শিল্পকলা অ্যাকাডেমির পরিবেশনায় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান এবং রাতে মঞ্চায়িত হবে কালজয়ী উপন্যাস বিষাদ-সিন্ধু অবলম্বনে কয়া বাঘা যতীন থিয়েটারের পরিবেশনায় নাটক "ফুরাত নথির তীরে"।অমর এই কথা সাহিত্যিকের জন্মবার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষ্যে আয়োজিত গ্রামীণ মেলায় নাগরদোলাসহ হরেক রকমের পণ্যসামগ্রীর দোকানপাট বসেছে বাস্তুভিটার আশপাশের এলাকাজুড়ে। উল্লেখ্য, মীর মশাররফ হোসেন বাংলা সাহিত্যের একজন অন্যতম ঔপন্যাসিক।ঊনবিংশ শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ মুসলিম জাগরণের গদ্যশিল্পীও তিনি। ‘বিষাদ-সিন্ধু’ গ্রন্থে' তাঁর এই পরিচয় সুস্পষ্ট। শ্রীবজেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় মশাররফ হোসেনের অবদান সম্পর্কে উল্লেখ করেন, “বাংলাদেশে বাংলা সাহিত্যে হিন্দু ও মুসলমানের দান সম্পর্কে যদি স্বতন্ত্রভাবে বিচার করা চলে, তাহা হইলে বলিতে হইবে, একদিকে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মহাশয়ের যে দান, অন্যদিকে ‘বিষাদ-সিন্ধু’ প্রণেতা মীর মশাররফ হোসেনের স্থান ঠিক অনুরূপ।এদেশের মুসলমান সমাজে তিনিই সর্বপ্রথম সাহিত্য শিল্পী এবং এখন পর্যন্ত তিনিই প্রধান সাহিত্য শিল্পী হইয়া আছেন। উনিশ শতকের আলোকিত গদ্যকার কুষ্টিয়ার কুমারখালী উপজেলার গড়াই তীরবর্তী লাহিনীপাড়ার সম্ভ্রান্ত সৈয়দ পরিবারে মীর মশাররফ হোসেন (তদানীন্তন নদীয়া জেলায়) ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৩ নভেম্বর (২৮ কার্তিক ১২৫৪ বাংলা) জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম, সৈয়দ মীর মুয়াজ্জম হোসেন এবং মাতার নাম দৌলতুন্নিসা।মীর দিলস্নীর মুঘল সম্রাট মুহাম্মদ শাহের দেয়া খেতাব। মীর মশাররফ হোসেনের প্রপিতামহের পিতা সৈয়দ কুতুবুল্লাহ ‘মীর’ খেতাবে ভূষিত হয়েছিলেন। শেষ জীবনে তিনি রাজবাড়ীর পদমদীর নবাব এস্টেটের ম্যানেজার নিযুক্ত হন। ১৯১১ সালের ১৯শে ডিসেম্বর ৬৪ বছরে তিনি ইন্তেকাল করেন। পদমদীর মাটিতেই মীর মশাররফ হোসেন চিরনিদ্রায় শায়িত।মশাররফ হোসেনের উত্তর বংশধরদের মধ্যে তাঁর কনার পক্ষের বংশধররাই বিদ্যমান। হোসেনের আত্মচরিত “আমার জীবন’ পাঠে জানা যায় যে, তিনি ছাত্রজীবন হতেই সাহিত্য চর্চা শুরু করেন। কুষ্টিয়ার কুমারখালীর ঐতিহাসিক ‘গ্রামবার্ত্তার সম্পাদক কাঙাল হরিনাথ মজুমদার ছিলেন তাঁর সাহিত্যগুরু। কাঙাল হরিনাথের ‘গ্রামবার্তা’ ও ঈশ্বরগুপ্তের ‘সংবাদ প্রভাকর’ নামক পত্রিকা দুটিতে লিখেই তাঁর সাহিত্য চর্চা ক্রমশ. পরিণতি লাভ করে। তাঁর পূর্বে বাংলা গদ্যে তেমন কোন উল্লেখযোগ্য লেখক দেখা যায় না। তাঁর সাহিত্যকর্ম একদিকে যেমন অসাধারণ বৈচিত্র্যে ভরপুর, অন্যদিকে তেমনি প্রাচুয্যের দৃষ্টান্ত।মীর মশাররফ হোসেনের সাহিত্য প্রতিভাকে এক কথায় বিস্ময়কর বলা যায়। আধুনিক পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত না হয়েও এবং সাধারণ গ্রামীণ পরিবেশে জীবন-যাপন করেও সাহিত্য সাধনার ক্ষেত্রে তিনি যে গভীর জ্ঞান, অন্তর্দৃষ্টি ও নৈপুণ্যের পরিচয় দিয়েছেন তা একান্তই দুর্লভ।